৩য় পর্ব
নিঝুম দ্বীপে নিভৃতে ঝরছে রোকসানাদের প্রাণ
দ্বীপ আজাদ, নোয়াখালী
প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮:৫৫
রোকসানা বেগম (২৫)। নিঝুম দ্বীপের বাসিন্দা। এক সন্তানের জননী অন্তঃসত্ত্বা রোকসানার সন্তান জন্মের মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে। হঠাৎ এক রাতে শুরু হয় প্রসব বেদনা। সকালেই নেওয়া হয় দ্বীপের ক্লিনিকে। অবস্থা বেগতিক দেখে পাঠানো হয় হাতিয়ায়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে গেলে অবস্থা আরও খারাপ হয়। বলা হয় জেলা সদরে নিতে। কিন্তু রোকসানার পরিবার বেসরকারি হাসপাতালে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়। অবশেষে তার কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে এক শিশু। কিন্তু রোকসানার আরও অবনতি হয়। জেলা সদরে নেওয়ার পথে ট্রলারেই প্রাণ যায় রোকসানার।
দ্বীপের বন্দরটিলা এলাকায় শুধু গেল এক মাসে রোকসানার মতো তিন অন্তঃসত্ত্বা মায়ের প্রাণ যায়। গোটা দ্বীপের অবস্থা আরও করুণ। নোয়াখালীর পর্যটন কেন্দ্র নিঝুম দ্বীপের স্বাস্থ্যসেবা একেবারে তলানিতে। এখানে নেই কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কিংবা সরকারি হাসপাতাল। তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও সেবা পাওয়া দায়- এমনটাই অভিযোগ স্থানীয়দের।
অন্তঃসত্ত্বা নারী, সড়ক দুর্ঘটনা বা জটিল রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসায় হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সই একমাত্র ভরসা। কিন্তু ৬০ কিলোমিটার সড়ক ও জলপথ ডিঙিয়ে যেতে যেতে অনেকেই আরে বেঁচে ফেরেন না। চিকিৎসার জন্য ভরসা স্থানীয় ফার্মেসি।
নিহত রোকসানার স্বামী উসমান মিয়া বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘হাসপাতাল না থাকার কারণে সময়মতো চিকিৎসা করাতে পারিনি। এজন্য আমার স্ত্রী মারা গেছে। দুই সন্তান নিয়ে আমি খুব কষ্টের মধ্যে আছি।’
নিহত রোকসানার বাবা বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে মেয়েটা মারা গেল। নাতি-নাতনিকে নিয়ে খুব বিপদের মধ্যে আছি।’
শুধু রোকসানা নয় দ্বীপের বন্দরটিলা এলাকায় এক মাসে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে তিনজন মায়ের। দরিদ্রতার কারণে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে জেলা সদরে চিকিৎসা নেওয়া অনেকটাই দুঃস্বপ্ন এখানকার মানুষের জন্য। দ্বীপে তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র থাকলেও নেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। জরাজীর্ণ এসব ক্লিনিকে হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার থাকলেও তাদের দেখা মেলে কালেভদ্রে। ফলে ভরসা স্থানীয় ফার্মেসি। তাই কখনো চিকিৎসা না পেয়ে, আবার কখনো ভুল চিকিৎসায় অকালেই প্রাণ হারাচ্ছেন রোকসানার মতো অনেকে। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ কিংবা ব্রেনস্ট্রোকের রোগীদেরও মৃত্যু হচ্ছে চিকিৎসা না পেয়ে।
এই দ্বীপে সরকারের সঙ্গে একসময় যৌথভাবে কাজ করত মা-মণি প্রকল্প। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের পরামর্শসহ নরমাল ডেলিভারির প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো প্রকল্পের অধীনে। কিন্তু বর্তমানে প্রকল্পটি বন্ধ। ফলে ভেঙে পড়েছে দ্বীপের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। আবার পর্যটনকেন্দ্র হওয়ায় পর্যটকরাও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন।
স্থানীয়দের পাশাপাশি পর্যটকদের কথা বিবেচনা করে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে নিঝুম দ্বীপে হাসপাতাল নির্মাণের দাবি এলাকাবাসীর।
আফজাল মিয়া বলেন, ‘ভালো ডাক্তার, হাসপাতাল কিছুই নেই। ফার্মেসি আমাদের একমাত্র ভরসা। জরুরি রোগীর ক্ষেত্রে নদী পার হতে অনেক সময় লাগে। দ্বীপে দ্রুত হাসপাতাল নির্মাণ জরুরি।’
এ বিষয়ে নোয়াখালী সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘নিঝুপ দ্বীপের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ হেল্থ সেন্টার প্রয়োজন। তাছাড়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সেবার জন্য কিছু পরিকল্পনা ও গঠনতন্ত্রের প্রয়োজন। বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগিতায় হাতিয়া এলাকায় কিছু ক্যাম্প করা হবে।’
দ্বীপ আজাদ/এমআই/ওএফ/এনআর/এমএইচএস