উজানের ঢলে নেমে আসা প্রচুর পাথর সীমান্তের কোয়ারিতে জমা হয় /ছবি : বাংলাদেশের খবর
প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যে ভরপুর দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনপদ সিলেট। ভারত সীমান্তঘেষা এ জেলায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম উৎস পাথর কোয়ারি। গেজেটভুক্ত বালু মিশ্রিত সিলেটের কোয়ারিগুলো হচ্ছে, গোয়াইনঘাটের জাফলং ও বিছনাকান্দি, কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ, উৎমা, শাহ আরেফিন টিলা ও রতনপুর এবং কানাইঘাটের লোভাছড়া ও শ্রীপুর।
ভারত থেকে বয়ে আসা নদ-নদীর উৎসমুখে থাকা এসব কোয়ারিতে প্রতি বছর জমা হয় পাথরের বিশাল ভাণ্ডার। বিশেষ করে জাফলং, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জ ও লোভাছড়া এসব ভাণ্ডারের দেখা মেলে।
আগে এসব কোয়ারি ইজারা নিয়ে বালু-পাথর উত্তোলন করা হতো। একপর্যায়ে যান্ত্রিকভাবে পাথর উত্তোলন শুরু হলে পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) দায়ের করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ২০১০ সালে পাথর উত্তোলন বন্ধের জন্য রায় দেন। পরে বেলার আরেকটি রিট আবেদনের রায়ের ফলে জাফলংকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়।
চোরাই পথে রমরমা
২০২০ সালের ৮ জুন খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো এক চিঠির মাধ্যমে সারা দেশের পাথর, সিলিকা বালু, নুড়িপাথর ও সাদা মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ করে। এরপর থেকেই সিলেটের কোয়ারিগুলোতে পাথর উত্তোলন বন্ধ আছে। তবে বৈধ পথ বন্ধ থাকলেও প্রতিনিয়ত লুট হচ্ছে বালু-পাথর।
মাঝে-মধ্যে অভিযানও হয়, কিন্তু থামানো যায় না অবৈধ কারবারিদের। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় শত কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে জাফলং ও ভোলাগঞ্জ থেকে।
সম্প্রতি জাফলং এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) টহল ও অভিযান জোরদার করায় এখানের জিরো পয়েন্ট এলাকায় কিছুটা কমেছে বালু-পাথর লুট। তবে থেমে নেই খেকোরা, লুট করছেন অন্যান্য এলাকা থেকে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পাথর লুট ঠেকাতে জাফলং জিরো পয়েন্ট এলাকায় আনসার ক্যাম্প স্থাপন করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তৌহিদুল ইসলাম। ২৪ ঘণ্টা নজরদারি করেন আনসার সদস্যরা। এছাড়া ঘন ঘন চালানো হয় টাস্কফোর্স অভিযান। ফলে কয়েকদিন ধরে জিরো পয়েন্ট এলাকা থেকে বালু-পাথর লুট হচ্ছে না।
বিএনপি নেতাদের পোয়াবারো
স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলনের বিষয়টি অনেকটা ওপেন-সিক্রেট। এ ক্ষেত্রে বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নাম সামনের কাতারে থাকলেও এবার উঠে এসেছে স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন নেতার নাম। পাথরলুট কাণ্ডে জড়িত থাকায় ইতোমধ্যে দুই নেতাকে পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে বিএনপি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই মাত্র দুদিনে জাফলং ও ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র থেকে প্রায় ৩০ কোটি টাকার পাথর লুট হয়। এর সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে সিলেট জেলা বিএনপির দুই নেতাকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
তারা হলেন, জেলা বিএনপিনেতা রফিকুল ইসলাম শাহপরান ও শাহ আলম স্বপন। তাদের প্রধান সহযোগী হিসেবে রয়েছেন পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্স।
এদের বিরুদ্ধে কয়েক দিন আগে স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ী জেলা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বালু-পাথর লুট, চাঁদাবাজি ও হামলা-মামলার অভিযোগ করেন। কয়েকজনের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলাও করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। বরং তাদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়েছে।
প্রশাসনের চোখের সামনে লুট
জিরো পয়েন্টের অদূরে নয়াবস্তি এলাকা থেকে প্রতিদিন রাতে বালু-পাথর লুট করা হচ্ছে। ভোলাগঞ্জেও লুটতরাজ বেড়েছে। প্রতিদিন কয়েক লাখ ঘনফুট পাথর ও বালু লুট হচ্ছে সেখান থেকে। সাদাপাথর যাওয়ার নৌকাঘাট থেকে ভোলাগঞ্জের ১০নং বাংকার এলাকাজুড়ে পুলিশ-বিজিবির চোখের সামনে দিনের বেলায় লুট হচ্ছে বালু-পাথর।
প্রতিদিন লাখ লাখ ঘনফুট বালু-পাথর লুট হচ্ছে কোয়ারিগুলো থেকে। পাথর উত্তোলনের ক্ষেত্রে পাথরখেকোরা ব্যবহার করছেন যন্ত্রও (৪০ ঘোড়া লিস্টার মেশিন)। এতে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে, অপূরণীয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উত্তোলন স্থলের পার্শ্ববর্তী সেতু, নদীরক্ষা বাঁধ ও সড়ক। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা দেখেও না দেখার ভান করছেন।
বেকার ১০ লাখ মানুষ
দীর্ঘদিন ধরে বৈধ পথে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে (হাতে) পাথর উত্তোলনের দাবি জানিয়ে আসছেন কোয়ারি সংশ্লিষ্ট অন্তত ১০ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে রয়েছেন লোড-আনলোড শ্রমিক, বারকি শ্রমিক, ক্রাশার মেশিন মালিক-শ্রমিক, ছোট থেকে বড় ব্যবসায়ী ও পরিবহন শ্রমিক।
উত্তোলন বন্ধ থাকায় বেকার দিন কাটাচ্ছেন তারা। অনেকেই এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এছাড়া কোয়ারিনির্ভর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে অচলাবস্থা থাকায় ব্যবসায়ীরা দেউলিয়া হয়ে গেছেন।
জীবন-জীবিকার তাগিদে গত কয়েক বছর ধরে কোয়ারিগুলো চালুর দাবিতে ব্যবসায়ী ও শ্রমিক নেতারা মন্ত্রণালয় এবং আদালতে ধরনা দিচ্ছেন। পাশাপাশি আন্দোলনও করছেন রাজপথে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
তারা বলছেন, আওয়ামী সরকারের আমলে একটি বিশেষ মহলকে পাথর আমদানির সুযোগ দিতেই বন্ধ রাখা হয় সিলেটের কোয়ারিগুলো। এসব কোয়ারি বন্ধ থাকায় বেড়েছে পাথরের দাম। খরচ বেড়েছে বাসা-বাড়ি নির্মাণ ও সরকারি অবকাঠামোগত উন্নয়নে।
নিজস্ব পাথর কোয়ারি বন্ধ রেখে বিদেশ থেকে রিজার্ভের ডলার খরচ করে পাথর আমদানির মাধ্যমে উন্নয়ন কাজ চালায় গত ১৫ বছরের আওয়ামী সরকার। রিজার্ভ সংকটে পড়ার এটাও অন্যতম কারণ। এছাড়া ইজারা দেওয়া বন্ধ থাকায় সরকারও প্রতি বছর বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। ফলে পরিবেশের দোহাই দিয়ে সিলেটের কোয়ারিগুলো বন্ধ রাখায় লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হচ্ছে।
নিভে গেছে আশার আলো
কোয়ারি সংশ্লিষ্টদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে, ২০২২ সালের নভেম্বরে তৎকালীন সরকারের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ নায়েব আলীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সিলেটের বিভিন্ন পাথর কোয়ারি পরিদর্শন করেন। পরে তারা প্রতিবেদনে শর্তসাপেক্ষ পাথর কোয়ারি খোলা যেতে পারে মত দেন।
তবে আওয়ামী লীগ সরকার কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। ফলে থেমে থাকেনি পাথর লুট। ইজারা বা নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রতিদিন উত্তোলন করা হয় বালু-পাথর।
এদিকে, খনিজসম্পদ ব্যুরো গত অক্টোবরে ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ভূতত্ত্ব) আশরাফ হোসেন ও উপ-পরিচালক (খনি ও খনিজ) মাহফুজুর রহমানকে কোয়ারি এলাকার পাথরের ফুটের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই দুই কর্মকর্তা সিলেট ও সুনামগঞ্জের কোয়ারিগুলো পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রতিবেদন জমা দেন। এর গ্যাজেট এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
আর গত ২০ নভেম্বর সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, কয়েকজন ব্যবসায়ীর আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত জাফলং, বিছানাকান্দি ও ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে হাত দিয়ে বালু-পাথর উত্তোলনের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে ওই আদেশের সার্টিফাই কপি জেলা প্রশাসনের কাছে আসেনি।
পরে জানা যায়, উল্টো একটি রিট আবেদন পড়ায় আগের আদেশ স্থগিত করেছেন আদালত। ফলে কোয়ারি সংশ্লিষ্টদের আশার আলো জ্বলে উঠতে না উঠতেই দপ করে নিভে যায়।
পাথরজটের কারণে বন্যা
কোয়ারিগুলো থেকে পাথর অপসারণ না করায় কয়েক বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে দফায় দফায় বন্যার কবলে পড়ছে সিলেট, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, উজান থেকে নেমে আসা পাথর স্তূপ হয়েছে নদ-নদীর উৎসমুখে। এতে নাব্যতা হারিয়েছ নদীগুলো। ফলে অল্প বৃষ্টি ও উজানের ঢলে মুহূর্তেই বন্যা হয় সিলেট অঞ্চলে।
‘প্রতিবছর উজানের ঢলের সাথে নেমে আসা প্রচুর পাথর ও বালু সীমান্ত এলাকায় নদীগুলোর নাব্যতা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে গত কয়েক বছর ধরে ঢলের পানিতে সিলেটে আকস্মিক বন্যা দেখা দিচ্ছে’
-অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম, সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)
কোয়ারি চালু আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত
বেলার সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ সাহেদা বলেন, ‘খেকোরা সিলেটের কোয়ারিগুলো থেকে এখন আর বালু-পাথর লুট করছে না, বরং প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে আদালত ও সরকারকে অমান্য করে এসব উত্তোলন করছেন। অতীতে কোয়ারিগুলোতে বড় বড় যন্ত্র দিয়ে পাথর তুলে পরিবেশ পুরোপুরি হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রাণহানি তো হয়েছেই।’
তিনি বলেন, ‘বেলার দায়ের করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ২০১০ সালে যান্ত্রিকভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ করার জন্য রায় দেন। পরবর্তীতে আরেকটি রিট আবেদনের রায়ের ফলে জাফলংকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়। ফলে এখান থেকে বালু-পাথরসহ কোনো ধরনেরই খনিজ সম্পদ আহরণের সুযোগ নেই।’
‘কোয়ারিগুলোর বিষয়ে সরকার ও আদালতের যে নির্দেশনা ছিল, সেটি জারি রয়েছে। কোয়ারিগুলোর বিষয়ে নতুন কোনো নির্দেশনা নেই’
- মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ, জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সিলেট
বেলার এই বিভাগীয় সমন্বয়ক বলেন, ‘যারা হাত দিয়ে বালু-পাথর উত্তোলনের দাবি তুলছেন, তারা সরকার বা আদালতের বিপক্ষে গিয়ে এ দাবি উত্থাপন করছেন। তাদের এ দাবি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। তাদের দাবি মেনে নিয়ে যদি সরকার কোয়ারিগুলো খুলে দেয়, তবে সেটি হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।’
যা বলছে প্রশাসন
সিলেট জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ‘কোয়ারিগুলোর বিষয়ে সরকার ও আদালতের যে নির্দেশনা ছিল, সেটি জারি রয়েছে। কোয়ারিগুলোর বিষয়ে নতুন কোনো নির্দেশনা নেই। আর ভূতাত্ত্বিক জরিপ বা পাথরের ফুটের দাম নির্ধারণের বিষয়টি আমার জানা নেই।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে। গত ২৭ নভেম্বর শাহ আরেফীন টিলায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকারীদের ভ্রাম্যমাণ আদালত দণ্ড প্রদান করেছেন।’
এটিআর/ওএফ