-67c5ae709fc01.jpg)
জন্মত্রুটি বলতে সাধারণ অর্থে জন্মের পর শিশুর অস্বাভাবিকতাকে বুঝায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় সুস্থ স্বাভাবিক শিশুর মত আচরণ বা দৈহিক গঠন যে শিশুদের মধ্যে দেখা যায় না তাদের জন্মত্রুটি শিশু বলে।
জন্মগত ত্রুটি নিয়ে পৃথিবীতে প্রতি বছর তিন লাখের বেশি শিশু জন্ম নিয়ে মারা যায়। বাংলাদেশে জন্মত্রুটি নিয়ে জন্মানো শিশুর সংখ্যা ৯ শতাংশের বেশি।
দেশে জন্মত্রুটি শিশুর উচ্চহার হলেও এ বিষয়ে নেই পর্যাপ্ত গবেষণা। তাই শিশুদের জন্মত্রুটির কারণ অজানাই থেকে যাচ্ছে।
প্রতি বছর ৩ মার্চ নবজাতকের জন্মগত ত্রুটি এবং তাদের জন্য দায়ী কারণ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে তথ্য ও সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার ‘বিশ্ব জন্মত্রুটি দিবস’ পালিত হয়। এবারের প্রতিপাদ্য ‘প্রতিটি যাত্রা মূল্যবান’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতি ১০০ নবজাতকের মধ্যে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মায় ৩ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৩ লাখের বেশি শিশু মারা যায় জন্মগত ত্রুটির কারণে। শিশুমৃত্যুর চতুর্থ কারণ হিসেবে জন্মগত ত্রুটিকে চিহ্নিত করা হয়।
অন্যদিকে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে ৩৫ লাখ শিশু আজন্ম শারীরিক অথবা মানসিক প্রতিবন্ধী হিসেবে বেঁচে থাকে। সংস্থাটির বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোতে জন্মত্রুটি নিয়ে জন্মানো শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
এশিয়ার এ দুই অঞ্চলে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে জন্মগত ত্রুটির কারণ গত দশ বছরে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১১ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে জন্মগত ত্রুটি শিশুদের নিয়ে সর্বশেষ গবেষণা করেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ)। সেই গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নবজাতক বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা ১১ হাজার ২৩২ শিশুর মধ্যে ৭ থেকে ৯ শতাংশের বেশির জন্মগত ত্রুটি পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয় ৭৮৯ শিশুর, মৃত্যু হার ৭ শতাংশের বেশি।
জন্মত্রুটি নিয়ে জন্মানো শিশুদের বেশিরভাগ এসেছিল মধ্য ও নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে। যেসব রোগ বেশি পাওয়া গিয়েছিল সেগুলোর মধ্যে- মুখমণ্ডল বা ত্বকের ত্রুটি, বাড়তি আঙুল, মেরুদণ্ড-মজ্জা ও রক্তনালির টিউমার, হার্টে ছিদ্র, ঠোঁট কাঁটা, তালু কাঁটা অন্যতম।
জন্মত্রুটি শিশুদের নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন বিএসএমএমইউর ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজ-অর্ডার অ্যান্ড অটিজমের (ইপনা) পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহীন আখতার।
তিনি বলেন, জন্মগত ত্রুটির বেশিরভাগ কারণই অজানা থেকে যায়। তবে বেশ কয়েকটি কারণ খুব স্পষ্ট। জিনগত, খুব কম বা বেশি বয়সে সন্তান ধারণ, অপুষ্টি, সংক্রামক রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হরমোনজনিত সমস্যা, অপচিকিৎসার মত কারণগুলো প্রধানত চিহ্নিত করা যায়।
জন্মত্রুটি প্রতিকারের বিষয়ে তিনি বলেন, বেশি বয়সে মেয়েরা গর্ভবতী হলে সবসময় শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা জরুরি। কারণ বেশি বয়সে গর্ভবতী মায়ের শিশুর জন্মত্রুটির ঝুঁকি বেশি থাকে। পরীক্ষা-নিরক্ষার মাধ্যমে গর্ভ অবস্থায় শিশুর জন্মগত ত্রুটি চিহ্নিত করা গেলে অনেক সময় শিশু জন্মের পরপরই জন্মত্রুটির চিকিৎসা দেয়া যায়। এতে শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি কমে আসে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে এখনও অনেক কুসংস্কার রয়েছে। কোন শিশু জন্মত্রুটি নিয়ে জন্মালে কোনো আয়ুর্বেদি, হারবাল, কবিরাজি ওষুধ সেবন না করিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। দেশে জন্মত্রুটি শিশুর জন্মহার কমানো ও মৃত্যু এড়াতে এ বিষয়ে আরও গবেষণার তাগিদ দেন।
বাংলাদেশে জন্মত্রুটি শিশুদের নিয়ে কয়েকটি দেশী ও বিদেশি স্বাস্থ্য সংস্থা কাজ করলেও এ বিষয়ে তেমন গবেষণা নেই। বর্তমানে বাংলাদেশে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে ‘নিউবর্ন বার্থ ডিফেক্ট সার্ভিলেন্স ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি প্রকল্প চালু রয়েছে। দেশের ২০টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল/ ইনস্টিটিউটে এই প্রকল্প পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রকল্পটিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এসইএআরও এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সহায়তা করে থাকে।
প্রকল্পটির কো-অর্ডিনেটর ডা. শাহ নিজাম উদ্দীন বলেন, শিশুর জন্মগত ত্রুটির অন্যতম কারণ জেনেটিক এবনরমাল ডিজিজ। এদের প্রথমে ডায়াগনসিস করতে হয়। এর জন্য জেনেটিক ডিবিশন বা জেনেটিক ল্যাব দরকার। যা আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। জন্মত্রুটি শিশুদের চিকিৎসা উন্নয়ন না করা গেলে দেশে জন্মত্রুটি শিশু মৃত্যুহার কমানো সম্ভব হবে না।
এসআইবি/এমএইচএস