টেক্সাসের গ্রামে বিশাল সম্রাজ্য গড়ছেন ইলন মাস্ক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৫, ১৩:১৮

রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ছেড়ে টেক্সাসের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন ব্যবসায়িক সম্রাজ্য গড়ছেন ইলন মাস্ক। তার নতুন প্রতিবেশীরা এ বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন।
অস্টিনের পূর্ব দিকে আধা ঘণ্টা দূরত্বে, বিমানবন্দর পার হয়ে যখন শহরের যানজট শেষ হয় তখন চোখে পড়ে সেন্ট্রাল টেক্সাসের অবারিত প্রান্তর। শহুরে কোলাহলের বাইরে এ যেন এক গ্রামীণ পরিবেশ।
দুই লেনের মহাসড়ক ধরে এগিয়ে বামে মোড় নিলে ‘ফার্ম-টু-মার্কেট রোড ১২০৯’। ঠিকানাটা হাই-টেক হাবের জন্য বিদঘুটে মনে হয়। কিন্ত সেটি যদি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ট ইলন মাস্কের সাথে হয়— তাহলে হয়তো ঠিক মানিয়ে যাবে।
নথিপত্র বলছে, সাম্প্রতিক তৈরি হওয়া একটি বড় স্টিলের ভবনই হতে চলেছে তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’-এর নতুন সদরদফতর।
এই ভবন থেকে কিছুটা দূরেই দেখা যায় মাস্কের অবকাঠামো নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘দ্য বোরিং কোম্পানি’-র বিশাল লোগো লাগানো আরেকটি ভবন। আর ফার্ম-টু-মার্কেট রোড ১২০৯-এর অপর পাশে নির্মিত হচ্ছে ‘স্পেসএক্স’-এর একটি স্থাপনা, যেখানে তৈরি হচ্ছে স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের সরঞ্জাম।
বেশিরভাগ প্রযুক্তি উদ্যোক্তার মতো মাস্কও দীর্ঘদিন সিলিকন ভ্যালিকেই নিজের বাসা ও কার্যালয় হিসেবে রেখেছিলেন। এক সময়ের ডেমোক্র্যাট সমর্থক মাস্কের টেক্সাসে চলে আসা প্রযুক্তি জগতের বড় একটি প্রবণতারই অংশ। একই সঙ্গে তার নিজের আদর্শগত অবস্থান বদলানোরও ইঙ্গিত বহন করে।
এখানকার জমি তুলনামূলকভাবে সস্তা, পাশের অস্টিন শহর থেকে দক্ষ প্রযুক্তিকর্মী পাওয়া সহজ। এছাড়া স্থানীয় আইনও ব্যবসা উপযোগী। তবে এই স্থানান্তরের পেছনে রাজনৈতিক কিছু কারণও আছে।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে মাস্ক ঘোষণা দেন, তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ছেড়ে দিচ্ছেন। কারণ রাজ্যটি একটি আইন পাস করে যাতে শিক্ষকরা ছাত্রদের লিঙ্গ পরিচয় পরিবর্তনের বিষয়ে পরিবারকে জানাতে বাধ্য নন।
মাস্কের একটি ট্রান্সজেন্ডার কন্যা রয়েছে— বর্তমানে তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি প্রকাশ্যে ‘ওয়োক মাইন্ড ভাইরাস’ এর সমালোচনা করে আসছেন—যেটিকে তিনি বিভেদমূলক পরিচয় রাজনীতির উদাহরণ বলেন। তিনি মেধা-বিরোধী ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী চিন্তাধারার বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন।
এই কারণেই মাস্ক তার ব্যবসা সরিয়ে নিয়ে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ও রিপাবলিকান-প্রভাবিত রাজ্য টেক্সাসে।
কেন্দ্রীয় টেক্সাসের বাসট্রপ এলাকার কাছে মাস্ক গড়ে তুলেছেন একাধিক স্থাপনা। পাশাপাশি টেক্সাসের দক্ষিণ প্রান্তে, মেক্সিকো সীমান্তঘেঁষা ক্যামেরন কাউন্টিতেও একটি স্পেসএক্স কেন্দ্র তৈরি করেছেন। সেই কেন্দ্রের কর্মীরা ‘স্টারবেস’ নামে একটি নতুন শহর গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন, যা মে মাসে ভোটে উঠবে।
এটা নিয়ে বাসট্রপে স্থানীয়দের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
বাসট্রপ শহরের সিটি ম্যানেজার সিলভিয়া ক্যারিলো বলেন, ‘মনে হয় যেন আমাদের একটা দ্বৈত ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছে। শহরের জনসংখ্যা এখন ১২ হাজার ছাড়িয়েছে। স্থানীয়রা খুশি যে তাদের সন্তান-নাতিরা এখানে কাজ পাবে।’
তিনি বলেন, ‘আবার অনেকের মনে হয়, আমরা যেন একটা বহিরাগত শক্তির চাপে পড়ে যাচ্ছি। এই উন্নয়ন খুব দ্রুত আমাদের এলাকাকে শহরমুখী করে তুলছে।’
যদিও মাস্কের এই প্রকল্প শহরের বাইরে, তবু কাছাকাছি হওয়ায় টেক্সাসের আইনে বাসট্রপ প্রশাসনের কিছু কর্তৃত্ব আছে। ক্যারিলো জানান, মাস্কের এই প্রকল্প এখানকার বহু উন্নয়নের মধ্যে কেবল একটি।
তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে। তাই আমাদের বাড়ি ভাড়া, জমির মূল্য ও পরিবেশের মতো বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিতে হবে ।
মাস্কের সম্রাজ্য এখনো প্রাথমিক স্তরে। ‘হাইপারলুপ প্লাজা’ নামের এক জায়গায় রয়েছে কোম্পানির নিজস্ব একটি বার, কফি শপ, সেলুন ও গিফট শপ রয়েছে।
বাসট্রপ শহরের এই উন্নয়ন যেন পুরো টেক্সাস জুড়ে শুরু হওয়া ব্যাপক তৎপরতারই প্রতিচ্ছবি। অস্টিনের আকাশে সারাক্ষণ ক্রেন দোলে। আর আবাসন ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠছে।
শহরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চান স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও বাসিন্দারা। তাই মাস্ককে নিয়ে সাধারণ মানুষদের মনোভাবও মিশ্র। কেবল তার রাজনীতি নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে ভাবনাও এর সঙ্গে জড়িত।
স্থানীয় রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী জুডাহ রস বলেন, ‘এই উন্নয়নের ফলে জনসংখ্যা বেড়েছে, যা শুরু হয়েছিল অস্টিনের বুম দিয়ে, পরে কোভিডের সময় বাড়ে।’
রস বলেন, ‘আমাকে স্বভাবতই পক্ষপাতদুষ্ট হতে হবে, কারণ আমি চাই এটা দিন দিন বাড়তে থাকুক। আমি এখানকার পরিবেশ ভালোবাসি ও এর অংশ হতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘অন্তত এটা ভালো যে এখানে অনেক চাকরি তৈরি হচ্ছে। গত বছর আমি এমন অনেকের কাছে বাড়ি বিক্রি করেছি যারা বোরিং কোম্পানি ও স্পেসএক্সে কাজ করেন।’
টেক্সাসের আরেক বাসিন্দা আলফোনসো লোপেজ, যিনি সিয়াটলে টেক চাকরি শেষে ফিরে এসেছেন, শুরুতে ভেবেছিলেন বাসট্রপে বাড়ি কিনে বিক্রি করে লাভ করে চলে যাবেন। কিন্তু খুব দ্রুতই তিনি এই শহরে মুগ্ধ হয়ে পড়েন—স্থানীয় ব্যবসা আর বন্ধুসুলভ মানুষের মিশ্রণে। এখন তিনি এখানেই থাকতে চান।
মাস্ককে তিনি খুব পছন্দ করেন না, তার কিছু ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ও রাজনীতিরও সমালোচনা করেন। তবু মাস্কের কোম্পানিগুলোর প্রযুক্তি তাকে মুগ্ধ করে। তার মতে, কোম্পানিগুলো প্রতিবেশী হিসেবে ভালো থাকলে তার আপত্তি নেই।
তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আমার পানির উৎস নষ্ট না করে বা আমার বাড়ির নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ করে গর্ত না বানায়, ততক্ষণ ঠিক আছে।’
পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা টিনের দোকানঘর দেখিয়ে বলেন, ‘আমি এখানে এসে খেলা দেখব।’
তবে তার পানি নিয়ে উদ্বেগ কল্পনাপ্রসূত নয়। গত বছর, পানি দূষণজনিত অপরাধে টেক্সাসের পরিবেশ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘দ্য বোরিং কোম্পানি’কে ১১ হাজার ৮৭৬ ডলার জরিমানা করে।
প্রথমে বর্জ্যমিশ্রিত পানি কলোরাডো নদীতে ফেলতে চেয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। তবে স্থানীয়দের চাপের মুখে তারা সেগুলো বাসট্রপের বর্জ্য শোধনাগারে পাঠাতে রাজি হয়।
এই পানি সমস্যা বাসস্থান নির্মাণ প্রকল্পেও প্রভাব ফেলেছে, যেখানে মাস্কের কর্মীদের জন্য ১০০টির বেশি ঘর তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এখনো তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। আপাতত বোরিং বোডেগার পেছনে কিছু অস্থায়ী ট্রেইলারই কর্মীদের থাকার জায়গা। চারপাশে শুধু টেক্সাসের প্রান্তর, ঘোড়া আর কিছু ঘাস।
সিটি ম্যানেজার ক্যারিলো জানান, বড় পরিসরে বাড়ি নির্মাণ অন্তত আরও এক বছর পরে শুরু হবে।
২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে স্পেসএক্স আবেদন করেছে তাদের বাসট্রপ কারখানাকে ‘ফ্রি ট্রেড জোন’ ঘোষণা করতে। এতে তারা উপকরণ আমদানি ও পণ্য রপ্তানি করতে পারবে শুল্ক ছাড়াই— যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি প্রধান অর্থনৈতিক নীতি।
এটা যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত ব্যাপার। সেখানে এমন শত শত জোন রয়েছে।
স্থানীয় কর্মকর্তারা এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেছেন, যদিও এতে কাউন্টির আয় প্রায় ৪৫ হাজার ডলার কমে যাবে বলে ধারণা। তবে অর্থনীতির জন্য এটি ইতিবাচক বলে মনে করছেন তারা।
এছাড়া, টেক্সাস সরকার এ প্রকল্পে ১ কোটি ৭৩ লাখ ডলার অনুদান দিয়েছে, যাতে ৪০০ নতুন চাকরি ও ২৮ কোটি ডলারের বিনিয়োগ আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা কোনো সাংবাদিকের সামনে মাস্ককে সরাসরি সমালোচনা করতে চাননি। তবে অনলাইনে ব্যাপারটা আলাদা—সেখানে ক্ষোভ অনেক বেশি।
একটি ফোরামে স্থানীয় এক বাসিন্দা লিখেছেন, ‘ওরা আশপাশের সবকিছু ধ্বংস করে দেবে। ওর সঙ্গে ভালো কিছু আসে না।’
বাসট্রপ সম্প্রতি আইন করেছে যাতে ঘনবসতিপূর্ণ আবাসন ঠেকানো যায় এবং সবুজ এলাকা সংরক্ষিত থাকে। কলোরাডো নদীতে বর্জ্য ফেলার ঘটনায় বোরিং কোম্পানি যে জরিমানা দিয়েছে, তা নিয়েও এলাকাবাসী সচেতন।
বিবিসি স্পেসএক্স, বোরিং কোম্পানি ও এক্স-এর কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য চেয়েছিল।
ক্যারিলো জানান, মাস্কের ওয়াশিংটন সংক্রান্ত তৎপরতা নিয়ে স্থানীয়দের ব্যক্তিগত ক্ষোভ তেমন একটা দেখা যায়নি।
তবে শহর রক্ষায় প্রশাসন যে পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন পার্ক সংরক্ষণ ও কম ঘনত্বের আবাসন আইন, তা শহরের পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রাখবে বলেই তার আশা।
তিনি বলেন, বাসট্রপ একটি রক্ষণশীল ও ঐতিহ্যগতভাবে রিপাবলিকান অধ্যুষিত জায়গা।
ক্যারিলো বলেন, ‘জাতীয় পর্যায়ে ওর যা কর্মকাণ্ড, সেটা এখানে তেমন গুরুত্ব পায় না। তার কোম্পানিগুলো এখন পর্যন্ত ভালো, আশা করি ভবিষ্যতেও তাই থাকবে।’
ওএফ