‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ নামে কোনো সংগঠন নেই : জসিমুদ্দীন রাহমানী

বিবিসি
প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১৮:১৮
-67f908986e7c3.jpg)
বাংলাদেশে ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর জঙ্গিবাদের বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত শত শত ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। কারা কর্তৃপক্ষের হিসেবে এখন পর্যন্ত এই সংখ্যা তিন শতাধিক। জামিনপ্রাপ্তদের মধ্যে সন্দেহভাজন, বিচারাধীন, এমনকি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিও রয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জামিনে মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে বিগত সরকারের আমলে জঙ্গি তকমা দিয়ে আটক নিরাপরাধ ব্যক্তিরা যেমন আছেন তেমনি বিভিন্ন জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িতরাও এ সময়টিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন।
জঙ্গি মামলায় অভিযুক্ত কতজন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন এ বিষয়ে কারা মহাপরিদর্শক ব্রি. জে. সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘সংখ্যাটি তিন শ’র অধিক। তিন শ’ প্লাস বন্দি মুক্তি পেয়েছেন যাদের অনেকে বিভিন্ন জঙ্গি সংক্রান্ত অপরাধের সাথে হয়ত বা অভিযুক্ত ছিল। সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন এবং যারা হিনিয়াস ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত অথবা সরাসরি বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমের সাথে জড়িত ছিল তাদের ব্যাপারে কিন্তু সরকার পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর মধ্যে অনেকেই কিন্তু আবার রি-অ্যারেস্টও হয়েছে।’
আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান হিসেবে অভিযুক্ত ও কারাভোগ করা মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানী বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বেশিরভাগ লোক জেলে ছিল নিরপরাধভাবে। আর যদি কিছু সামান্য ভুলটুল করেও থাকে, ভুল বুঝতে পেরে তারা তওবা করেছে।’
গত আট মাসে জঙ্গি মামলায় অভিযুক্ত নিষিদ্ধ সংগঠন জেএমবির ১৪৮ জন জামিনে মুক্ত হয়েছেন। এ ছাড়া জামিন নিয়ে জেল থেকে বেরিয়েছেন এমন ব্যক্তিরা বিগত সরকারের সময়ে উগ্রবাদী সংগঠন হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকাভুক্ত সংগঠন হরকাতুল জিহাদ, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া, আনসার আল ইসলাম, ইমাম মাহমুদের কাফেলা, হিজবুত তাহরীর, হামজা ব্রিগেড, কেএনএফ এবং আল্লার দলের সদস্য বলেও জানা যায়।
জঙ্গি সংগঠন হিসেবে এসব নাম নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্ক আছে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান হিসেবে অভিযুক্ত মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানী ৫ আগস্টের পর জামিনে মুক্ত হয়েছেন। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব স্বীকার করতে চান না তিনি। তার দাবি- এ নামে কোনো সংগঠনের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা নেই ।
তিনি বলেন, আমার তো মনে হয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে বাংলাদেশে কোনো দলের অস্তিত্ব ছিল না। এটা তৈরিই করা হয়েছিল বাংলাদেশকে একটা জঙ্গি রাষ্ট্র দেখাইয়া নিজেদের কিছু ফায়দা অর্জন করার জন্য।’
জামিনে মুক্ত মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানীকে ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া একাধিক মামলা ছিল তার বিরুদ্ধে। ১১ বছরের বেশি সময় তিনি কারাবন্দি ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টে যখন গেল জামিনের জন্য। হাইকোর্ট দেখলো মামলাগুলোর যে সাজা আছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি খাটা হয়ে গেছে। প্রথম যে মামলাটা বরগুনায় হয়েছিল তথ্য প্রযুক্তির সে মামলায় আদিলুর রহমানসহ আরও যারা গ্রেপ্তার হয়েছিল তারা খালাস হয়ে গেছে অনেক আগেই। অথচ আমার জামিনই হয় নাই। আদালত আমাকে সব মামলায় জামিন দিয়ে দিল। এটা শেখ হাসিনার আমলেই কিন্তু। নতুন যে মামলাটা দিছিলো এই মামলাটা এই সরকারের সময় জামিনটা হইছে।’
গত ৮ মাসে যারা জামিন পেয়েছেন তার মধ্যে হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি রয়েছেন যেটি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করতে দেখা গেছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে। ২০১৬ সালে হত্যাকাণ্ডের শিকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আ ফ ম রেজাউল করীম সিদ্দিকীর পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয় আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বিচারাধীন দুজন আসামি জামিনে মুক্তির বিষয়টি তারা জেনেছেন। বিবিসি বাংলা ওই আসামিদের জামিনে মুক্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে।
রেজাউল করীম সিদ্দিকীর ছেলে বলেন, ‘এর থেকে হতাশাজনক আর কিছু হইতে পারে না। কিন্তু আমরা এটাও চাই নির্দোষী কেউ যাতে সাজা না পাক। আবার কেউ যদি কাউকে নির্দোষ দাবি করেও তাহলে কিন্তু এটা প্রমাণ করারও থাকে যে আসলে কে ইনভলব ছিল, কে ছিল না। কাকে কেন ইনভলব করা হয়েছে। আমার মা যেমন হতাশ হয়ে মাঝে মাঝে বলে যে বেঁচে থাকতে দেখে যেতে পারবো কি না। তো আমরা চাই মা বেঁচে থাকতে থাকতে তার স্বামীর বিচারটা দেখে যাক।’
আশির দশকের শেষ দিক থেকে বাংলাদেশে উগ্রবাদ ও জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে অনুসন্ধান ও খোঁজ খবর রাখেন নূর খান লিটন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নিয়ে সত্যতা যেমন আছে তেমনি নাটকীয়তাও রয়েছে।
‘বাংলাদেশে জঙ্গি নির্মূল বা জঙ্গি তৎপরতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে অভিযানগুলি হয়েছে সেই অভিযানগুলির মধ্যে যেমন সত্যতা আছে তেমনি নাটকীয়তাও আছে। জঙ্গি তকমা লাগিয়ে এক ধরনের উৎসবের মতো র্যাব, পুলিশ সাধারণ মানুষকে জঙ্গি তকমা দিয়ে আটকিয়ে ফেলেছে। কোনো কোনো ঘটনায় নাটক করে অনেককে হত্যাও করেছে।’
‘তবে যারা তকমার শিকার হয়ে জেলে ছিলেন তারাই শুধু জামিন পাচ্ছেন বা বেরিয়ে আসছেন তা না। যারা প্রকৃত অর্থে এই ধরনের জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের একটা অংশ কিন্তু জামিন বা জেল থেকে পালিয়ে এসেছেন। এর মধ্য দিয়ে মূল যে অপরাধীরা তারা কিন্তু এক ধরনের পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।’
বাংলাদেশে অতীতে বড় সন্ত্রাসী হামলা, হত্যাকাণ্ড, দেশজুড়ে বোমা হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। কিছু ঘটনায় ঘটনায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনকে দায় স্বীকার করতেও দেখা গেছে। সারাদেশে ৬৩ জেলায় এক যোগে বোমা হামলা হয়েছে, ব্লগার লেখক, প্রকাশক, শিক্ষক, বিদেশি নাগরিকদের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। হলি আর্টিজানে হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে।
২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বেশ কিছু ঘটনায় মারাত্মক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছিল জঙ্গি তৎপরতা ঘিরে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব ঘটনা এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে।
জঙ্গিবাদ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘জঙ্গি তৎপরতার সব ঘটনা প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ নেই। যে ধরনের পরিবেশ পরিস্থিতি আমাদের দেশে বিরাজ করেছিল একটা সময় সেই জায়গা থেকে একটা অবস্থানে উন্নতির জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। পুরা বিষয়টিকে আমরা মিথ্যা বা নাটক বলে চালিয়ে দিতে পারবো না। আইনত আমাদের প্রকৃত ঘটনাগুলির বিচার হওয়া উচিৎ। আর যে ঘটনাগুলি মিথ্যা ছিল, নাটক ছিল বা তকমা লাগিয়ে দেয়া ছিল সেগুলোকে বিচার করে একটা ফয়সালা করে তাদেরকে মুক্ত করে দেয়া উচিত।’
কারা সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী- গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানের সময় ৫টি জেল থেকে ২ হাজার দুই শ’ বন্দি পালিয়েছিল। এর মধ্যে এখনো ৭০০ জন পলাতক রয়েছে। পলাতকদের মধ্যে ৬ জন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য ছিল বলে জানান কারা মহাপরিদর্শক।
কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে ৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে অভিযুক্ত ১২ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী, আলোচিত দশট্রাক অস্ত্র মামলার ৮ জন আসামি এবং অন্তত ১০টি সংগঠনের সদস্য মিলিয়ে মোট ৩৪৬ জন জামিনে মুক্ত হয়েছেন।
নূর খান লিটন বলেন, ‘আমরা ৫ আগস্টের পর পর যেটি লক্ষ্য করেছি এই ধরনের আসামি যারা ছিলেন অত্যন্ত তড়িৎ গতিতে তারা কিন্তু জামিন নিয়ে ফেলেছেন। জামিন তো তার অধিকার। ফলে যারা জঙ্গি তকমা অর্থাৎ মিথ্যা অভিযোগে যাদেরকে আটক রাখা হয়েছিল তারা যেমন জামিন পেয়েছেন আবার যারা প্রকৃতপক্ষে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারাও জামিনটা নিয়ে নিচ্ছেন। এবং যারা জঙ্গি তৎপরতার মধ্যে ছিলেন তারা কিন্তু খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই সময়টিকে কাজে লাগিয়ে সংঘবদ্ধভাবে আদালতের মাধ্যমে জামিনটি নিয়ে নেন। কেউ কেউ কিন্তু জেলখানা ভেঙেও বেরিয়েছেন।’
অনেক অস্ত্র খোয়া গিয়েছে যেগুলো এখনো উদ্ধার হয়নি উল্লেখ করে নূর খান বলেন, ‘এই অস্ত্র উদ্ধারের ব্যাপক তৎপরতা আমরা দেখিনি। এখনও অনেক অস্ত্র বাইরে রয়েছে। এবং এর যদি একটা অংশ এ ধরনের জঙ্গি কাজে ব্যবহার হয় ভবিষ্যতে অর্থাৎ তারা যদি সংগ্রহ করে থাকে সেটি কিন্তু আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে।’
এদিকে জঙ্গি মামলায় অনেকেই জামিনে মুক্ত হলেও সেটি আইনশৃঙ্খলার অবনতি বা নিরাপত্তার কোনো হুমকি হবে না বলে দাবি করেন জসীম উদ্দিন রাহমানী।
তার ভাষায়, ‘আপনি দেখেন যারা বের হয়ে গেছে তারা কোনো ঘটনা ঘটাইছে কিছু। কিচ্ছু ঘটে নাই। আমি আপনাদের বলতে পারি ইনশাআল্লাহ কিছু হবেও না। কারণ বেশিরভাগ লোক জেলে ছিল নিরপরাধভাবে। আর যদি কিছু সামান্য ভুলটুল করেও থাকে তো সেটাও তারা এখন দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার পর বাস্তবতা বুঝতে পেরেছে যে এইগুলো সব ভুয়া, ভাওতাবাজি; এর দ্বারা ইসলামের কিছু হবে না। তারা ভুল বুঝতে পেরে তারা তওবা করেছে।’
ডিআর/বিএইচ