বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক বন্ধনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু বেশ কিছু ইস্যুতে সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব থেকে সাপ-বেজি সম্পর্কে পরিণত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে কয়েক মাস ধরে জমাট বাঁধা উত্তেজনা এবার সামনে এসেছে। তবে সম্পর্ক যাই হোক, ভারতের অযৌক্তিক কোনো কর্মকাণ্ডে ছাড় দেবে না বাংলাদেশ।
গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয় শেখ হাসিনা সরকার। এরপর পালিয়ে গিয়ে তিনি ও শেখ রেহানাসহ তার সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী-এমপি ভারতে আশ্রয় নেন। মূলত সেখানে হাসিনার উপস্থিতি এবং কিছু কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন বাড়িয়েছে।
সর্বশেষ এ দুই দেশের উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রামে হিন্দু পুরোহিত চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার। এক সময় ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইসকন) নামক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এ পুরোহিত। গত ২৬ নভেম্বর রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে কারাগারে পাঠান চট্টগ্রামের একটি আদালত। এরপর থেকে চিন্ময়ের সমর্থকরা আদালত ঘিরে ধরলে পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে নিরাপত্তা বাহিনী হিমশিম খায়। এ সময় আদালত প্রাঙ্গণে চিন্ময়ের সমর্থকরা একজন আইনজীবীকে হত্যা করে।
পুলিশের তরফ থেকে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু এ ইস্যুতে বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্কে নতুন করে টানাপড়েন শুরু হয়। প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে ‘কূটনৈতিক সম্পর্কের দৃশ্যত অবনতি’ ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের দাবি, ভারত থেকে ধারাবাহিকভাবে অতিরঞ্জিত ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করা হচ্ছে।
নিউইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বর্তমানে বেশ উত্তপ্ত। শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়া ও সেখান থেকে বাংলাদেশ সরকারকে চরমপন্থিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে প্রচার করাটা দুই দেশের সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর।
এদিকে সোমবার দুপুরে আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা হয়। সেখানে হামলা, ভাঙচুর, ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড ভেঙে বাংলাদেশের মর্যাদার প্রতীক জাতীয় পতাকা খুলে নিয়ে পোড়ানোর নিন্দনীয় ঘটনায় ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মাকে জরুরি ভিত্তিতে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া উগ্রপন্থিদের বিক্ষোভে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে, আগরতলাসহ ভারতে বাংলাদেশের সব মিশনের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য আগেই দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নোট পাঠানো হয়।
এরপর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার পর কনস্যুলার সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। গতকাল মঙ্গলবার অন্তর্র্বর্তী সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, নিরাপত্তার কারণে আপাতত আগরতলার বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে কনস্যুলার সেবা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে ওই মিশন থেকে বাংলাদেশের ভিসা সেবা বন্ধ থাকবে।
অন্যদিকে, সরকার ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের সামনে নিরাপত্তা জোরদার করেছে। বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি নামের একটি সংগঠন ভারতীয় দূতাবাস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেওয়ার পর এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সরজমিন দেখা যায়, ভারতীয় দূতাবাসে প্রবেশের বিভিন্ন রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বিশেষ করে রাজধানীর শাহজাদপুর এবং কূটনৈতিক জোন বলে পরিচিত সংলগ্ন এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখা গেছে। বাঁশতলা থেকে ভারতীয় দূতাবাসগামী কিছু রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগ।
গুলশান বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) তারেক মাহমুদ বলেন, দূতাবাস এলাকায় বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, দেশের সীমান্তে যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি বা অপতৎপরতা রোধে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) সম্পূর্ণ প্রস্তুত ও সতর্ক রাখা হয়েছে। গতকাল দুপুরে বিজিবির সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, দেশের সীমান্তে যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি কিংবা অপতৎপরতা রোধে বিজিবি সম্পূর্ণ প্রস্তুত ও সতর্ক রয়েছে।
এদিকে, নৌ-পরিবহন ও শ্রম-কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, প্রতিবেশী দেশ ভারত যদি সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ চুপ করে বসে থাকবে না। এমন পরিস্থিতিতে ভারতও ভালো থাকতে পারবে না বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। গতকাল নারায়ণগঞ্জের বন্দরে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) জেটি পরিদর্শন শেষে এ হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ভারতের কিছু মিডিয়া ও পলিটিক্যাল পার্টি ভোট পাওয়ার জন্য এটা (সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা) করছে। বাংলাদেশ যদি অস্থিতিশীল হয় তাহলে তারাও ভালো থাকতে পারবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক সেটি নিয়ে দেশটির সরকার সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।
অন্যদিকে, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আন্তরিকতা বাড়াতে যতটুকু যা করার আমরা তা করব। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এমন কথা বলেন তিনি।
এর আগে আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব এম রিয়াজ হামিদুল্লাহর দপ্তরে তাকে তলব করা হয়। বিকেল ৪টায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা উপস্থিত হন। ঠিক ওই সময়ই অফিস ছেড়ে যাচ্ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
এ সময় সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আজকে হাইকমিশনার কথা বলুক। ভিন্ন এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কে আন্তরিকতা বাড়াতে বাংলাদেশের যতটুকু যা করার আমরা তা করব।
ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেছেন, যাই হয়ে যাক না কেন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে। গতকাল বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
দুই দেশের সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করার আশা ব্যক্ত করে প্রণয় ভার্মা বলেন, যাই হোক না কেন আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখব। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আমরা কাজ করব। একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্ক আটকে থাকবে না।