বাংলাদেশ সচিবালয় /ছবি : বাংলাদেশের খবর
দায়িত্ব পালনের চার মাস অতিবাহিত হলেও বেশ কিছু খাতে এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিছু আমলার কারণে প্রশাসনের কার্যক্রমে গতি ফিরছে না। সরকারের কিছু দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে রাষ্ট্রযন্ত্র এখনো দেশ রক্ষাযন্ত্র হতে পারেনি। জনপ্রশাসনে ৭৮ সচিব পদের মধ্যে এখনো আওয়ামী সরকারের আজ্ঞাবহ ৩৬ সচিব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে শাসনামলে বঞ্চিত মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তারা এখনো পেছনে পড়ে আছেন।
জনপ্রশাসন বিশ্লেষকদের মতে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে বিতর্কিত করতে, তাদের বেকায়দায় ফেলতে, প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে থাকা শেখ হাসিনার আস্থাভাজন কর্মকর্তারা এ সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা করছে না। বরং তাদের কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপের কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা উঠে যাচ্ছে।
তারা বলছেন, যে সরিষা দিয়ে ভূত তাড়ানো হবে, সেই সরিষার মধ্যেই ভূত। আগেকার দিনে কারোর অপ্রকৃতিস্থ আচরণে যদি সন্দেহ সৃষ্টি হতো ‘ভূতে ধরেছে’, তখন ওই ভূত ছাড়ানোর জন্য নানারকম তুকটাক, ঝাড়ফুঁক- এসব করার নিদান চালু ছিল। ভূতের পাল্লায় যিনি পড়েই গেছেন, তার গায়ে, ‘শর্ষে’ ছেটানো হতো। বিশ্বাস ছিল শর্ষের ভয়ে ভূত পালিয়ে যাবে। সুতরাং ভূত সংক্রান্ত ‘সমস্যার’ জন্য, সমাধান হচ্ছে শর্ষে। তো, ‘শর্ষের ভেতরে ভূত’ বলতে বোঝানো হয়, সমস্যা সমাধান ব্যবস্থার মাঝেই, সমস্যা সৃষ্টিকারীর শক্ত অবস্থান। ফলে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের পর, দেশের প্রশাসন ঢেলে সাজানো যখন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দাবি, তখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নানা মহলে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়ে চলেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের আস্থাভাজন হিসাবে নিয়োগ পাওয়া ৩৬ সচিব এখনো সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বরত রয়েছেন। এদের বেশির ভাগই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন আয়োজনের কুশীলব ছিলেন। এমনকি আওয়ামী লীগের একজন সাবেক নারী সংসদ সদস্যের স্বামী এখনো সচিব পদে বহাল রয়েছেন।
জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনপ্রশাসন কার্যত আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী আমলাদের নিয়ন্ত্রণে। বিগত ১৮ বছর ধরে পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী আমলারা গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণে সম্প্রতি জেলা প্রশাসক নিয়োগেও তাদের প্রাধান্য ছিল। এসব আমলার কারণে প্রশাসনের কার্যক্রমে গতি ফিরছে না।
সম্প্রতি ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে এক মতবিনিময়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, আগের শাসকের ব্যুরোক্রেসি (আমলাতন্ত্র) রয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলাতন্ত্র পালটাতে আবার তাদেরই অনুগতদের প্রশাসনে বসানো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৭৮টি সচিব পদের বিপরীতে বর্তমান সরকারের ৯০ জন সচিব রয়েছেন। এর মধ্যে ৭২ জন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে সচিব হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন। এই ৭২ জনের মধ্যে ৩৬ জনই বিগত আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া সচিব। বাকি ৩৬ জনের মধ্যে আবার ১৩ জনকে চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৯০ সচিবের মধ্যে ১৮ জন ওএসডি।
প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতে, গত ১৫ বছরে প্রায় সবাইকে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিছু লোক ঢুকে পড়েছেন যারা কোনোমতেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। তারা নানা কায়দা-কানুন করে চাকরিতে ঢুকেছেন। কিছু লোক টাকার বিনিময়ে ঢুকেছেন। প্রশাসনের জানা মতে ভিন্নমতের লোকদের চাকরিতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কেউ কেউ মেধার জোরে চাকরি পেলেও পুলিশ ভেরিভিকেশনের নামে চাকরিতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। আর ভিন্নমতের যারা ছিলেন তাদের পদোন্নতি বঞ্চিত রাখা হয়। পটপরিবর্তন হলেও জনপ্রশাসনে বাস্তবে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
বিগত ১৫ বছরের সুবিধাভোগীরাই এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বিগত সরকারের সুবিধাভোগীদের কারণে কার্যত সারা দেশে পতিত ফ্যাসিবাদ সমর্থিতরা পুনর্বাসিত হচ্ছে। সরকারের নানা কর্মকাণ্ড কৌশলে তারা ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। সচিবালয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পতিত সরকারের ঘনিষ্ঠদের কাছে সহসাই পৌঁছে যাচ্ছে। বিগত বড় বড় দুর্নীতি সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় ফাইলপত্র সরিয়ে ফেলারও অভিযোগ উঠেছে। পদবঞ্চিতরা এখনো পদবঞ্চিত হিসেবেই আছেন। অদৃশ্য কারণে সচিব পদে তাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীদের প্রতি আস্থা রাখার কারণে নানা ধরনের সংকটও দেখা দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া সচিব যারা
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মোকাব্বির হোসেন, বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের কাজী এনামুল হাসান, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য সোলেমান খান, পরিকল্পনা কমিশনের আরেক সদস্য ড. মোহাম্মদ কাউসার আহাম্মাদ, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুর রউফ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কামরুল হাসান, ভূমি আপিল বোর্ডের মুহাম্মদ ইবরাহিম, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নাসরীন আফরোজ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফরিদ আহম্মেদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ড. মুশফিকুর রহমান, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নাজমুল আহসান, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আশরাফ উদ্দিন, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের আবুল কাশেম মহিউদ্দিন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এ কে এম শামিমুল হক ছিদ্দিকী, অর্থবিভাগের ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাহমুদুল হোসাইন খান, জাতীয় পরিকল্পনা একাডেমির মহাপরিচালক সুকেশ কুমার সরকার, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস একাডেমির রেক্টর ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নাজমা মোবারেক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ইসরাত চৌধুরী, অর্থনৈতিক সর্ম্পক বিভাগের শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী, জাতীয় উন্নয়ন প্রশাসন একাডেমির রেক্টর ড. সহিদ উল্লাহ, বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য রেহানা পারভীন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের রুহুল আমিন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সেলিম উদ্দিন, দুর্নীতি দমন কমিশনের খোরশেদা ইয়াসমীন, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের আমিন উল আহসান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান, লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাঈদ মাহবুব খান, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের ড. সারোয়ার বারী এবং বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মইনুল খান।
আওয়ামী লীগের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত এই ৩৬ সচিবের মধ্যে বর্তমান সরকারের আমলে চাকরিচ্যুত এক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী, আওয়ামী লীগের প্রয়াত কো-চেয়ারম্যান এইচটি ইমামের পিএস, আওয়ামী লীগের মহিলা এমপির স্বামী, সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর পিএস রয়েছেন। এছাড়া এসব সচিবের মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন আয়োজনে অন্যতম ভূমিকা পালনকারী সাতক্ষীরা, খুলনা, রংপুর, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইলসহ অন্যান্য জেলার জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালনকারীরাও রয়েছেন। অনেকের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যার অভিযোগ আছে। সচিব ছাড়াও অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপ-সচিব পদে আওয়ামী লীগের সাজানো প্রশাসনের আমলারাই বহাল তবিয়তে আছেন। আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী প্রশাসনের ওপর অতি নির্ভরশীলতায় সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে।
জনপ্রশাসনে ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৯৯৯ জনকে। একই সময়কালে পদোন্নতি পেয়েছেন ৩ লাখ ৩১ হাজার ৬৩৯ জন।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, বায়ান্ন বছরে এমন ২৩টি সংস্কার কমিশন হয়েছে। কতটুকু সুপারিশ নিয়েছে, আমি আপনি আমরা ভালোই জানি। এবার আমরা বি-প্রাকটিক্যাল, মানুষের কাছে গিয়ে যতটুকু গ্রহণযোগ্য সেটা দেওয়ার চেষ্টা করব।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, জনপ্রশাসনে আমরা কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য সুপারিশ করব। আমরা তিনটি গ্রুপ করে আমাদের কাজটা ভাগ করেছি। আমরা একটা প্রশ্নমালা দিয়েছি, আপনারা দেখেছেন। আসলে আমলাদের ওপর সবচেয়ে বেশি জুলুম আমলারাই করে।
ওএফ