বিদায়ী বছরের শুরুটাই হয়েছিল মানুষের ভোটাধিকার হরণের এক ডামি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। আর মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিতের প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বছর ২০২৫। চলছে রাষ্ট্রের সব খাতে সংস্কারের কাজ। তাই নতুন বছরে জাতীয় ঐক্যের প্রত্যাশা সব মহলের।
যদিও গত ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে পেছনে ফেলে, রাষ্ট্র গঠনের সম্মুখভাগে চলে এসেছে তরুণরা। যার ফলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংস্কার নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। এর মধ্যে সংস্কার আগে, নাকি নির্বাচন আগে; এ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোরও দূরত্ব বাড়ছে।
দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি এবং এর মিত্র দল ও জোটগুলোর বেশিভাগই প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার সেরে দ্রুত নির্বাচন চাইছে। অন্যদিকে কিছু রাজনৈতিক দলসহ ছাত্রনেতৃত্ব চাইছে, আগে ফ্যাসিস্টদের বিচার ও রাষ্ট্র সংস্কার হবে তার পরে জাতীয় নির্বাচন। ফলে জাতীয় ঐক্য নিয়ে অনৈক্য দেখা দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ বছর রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হতে পারে। তাই অনেকটা সতর্ক হয়ে চলতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে।
নতুন বছরে বহির্বিশ্বের দাসত্ব শিকল থেকে মুক্ত হয়ে, শক্ত পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে লাল সবুজের এই দেশটি। ধ্বংস হয়ে যাওয়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করে, রচিত হবে স্বনির্ভর বাংলাদেশের রূপকল্প। অতীতের দুঃখ-দুর্দশার স্মৃতি মুছে রচিত হবে নতুন অধ্যায়। রাজনৈতিক ঐক্যের হাত ধরে তৈরি হবে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য— ২০২৫ সালে এমন সব প্রত্যাশা করছেন সাধারণ ছাত্র-জনতা। তবে সব প্রত্যাশা ছাপিয়ে পঁচিশের মধ্যেই জুলাই গণহত্যার বিচারের তাগিদ তাদের।
২৫-এর রাঙা সকালে যে সূর্যটা উদিত হলো, তার পেছনের ইতিহাস কতটা বিষাদময়— অতীতের ৫৩টা সূর্যোদয় নিশ্চয়ই সেই সাক্ষ্য বয়ে চলে, অবশেষে অস্তমিত হয়েছে হতাশার কালো মেঘে ঢাকা আকাশে। ১৯৭১ সালে যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তি-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিকামী জনতা, প্রশ্নটা তো সেখানেই— স্বাধীনতার এত বছর পরও কেন ২৪ সালে এসে সেই একই মুক্তির আশায় রক্তে রঞ্জিত হয়েছে প্রিয় মাতৃভূমির জমিন।
৫২টা গ্লানিময় বছর শেষ করে যখন ৫৩তম বছর, তথা ২০২৪ এসে দাঁড়িয়েছিল লাল-সবুজের বাংলাদেশ; তার শুরুটাই হয়েছিল মানুষের ভোটাধিকার হরণের এক ডামি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। এরপর ভঙ্গুর অর্থনীতিতে মানুষের নাভিশ্বাস আর ফ্যাসিবাদের জাঁতাকলে পড়ে কত শত অধিকার বঞ্চিত হতে থাকল প্রজাতন্ত্রের মালিক নামের সাধারণ জনগণ। সব বঞ্চনার কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব বুঝিয়ে দিতে, বছরের ঠিক মাঝামাঝিতে তরুণ ছাত্র-জনতার রাজপথের লড়াই ছিল এক বিস্ফোরিত গণঅভ্যুত্থাণের দ্রোহযাত্রা। এর মাঝে কত প্রাণ অকালে ঝরেছে, কত দেহ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে নিয়েছে, তবুও তাদের একটাই প্রত্যয়— মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু।
যে প্রজন্ম বড় হয়েছে দীর্ঘ সময়ের দুঃখস্মৃতি নিয়ে, তারা চান আর যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় সেই রক্তাক্ত সংঘাতের বিষাদময় অধ্যায়। ইতিহাসের পাতার মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে যে প্রজন্ম, তারা বলছেন, এই যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হলো, সে উত্তরণটা যেন আরও বেশি স্থিতিশীল হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, দীর্ঘ সময় অতীতের দুঃখস্মৃতি নিয়ে আমাদের এ প্রজন্ম বড় হয়েছি। আমরা চাই ২৪ পরবর্তী সময়ে ২৫ সালে যখন আমরা পা রাখব তখন অতীতের যে কনফ্লিক্ট, আমাদের যে ব্লাডশেড, আমাদের যে অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে— এই স্মৃতিগুলোর আর পুনরাবৃত্তি আমরা চাই না। আমরা চাই ২৫ সালটা শুরু হোক ঐক্যের মধ্য দিয়ে। সংস্কারের মধ্য দিয়ে। এবং ঐক্য ও সংস্কারের সংমিশ্রণে আমাদের গণতান্ত্রিক যে যাত্রা নির্বাচনের দিকে, ২৫-এর মধ্য দিয়ে আমরা সেখানে যেতে চাই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, ‘আই জাস্ট হোপ ২০২৫ সালে আমাদের যে নবউত্তরণ হয়েছে, সেটাকে আমরা আরও স্ট্যাবল ফরমেশনের মধ্যে দেখতে পারব।’
২০২৫ সালে তাদের প্রত্যাশা, সমাজে থাকবে না কোনো বৈষম্য, মানুষ মানুষের মর্যাদা পাবে। প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায় বিচার। ফিরবে অর্থনীতির স্বনির্ভরতা। আর বিশ্বের দরবারে শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।
উমামা ফাতেমা বলেন, যখন ইউনূস সরকার এখানে ক্ষমতা নেয়, তখন তাদের কাছে কিন্তু শ্যাটারড দেশ। তাদের কিন্তু টুকরোগুলো জোড়া লাগাতে হচ্ছে। আমরা আশা করি, ২০২৫ সালে বাংলাদেশে যুগান্তকারী একটা পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। অন্তত দালিলিক পরিবর্তন। এই যে এত এত প্রত্যাশা তার জন্যই প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। পঁচিশের প্রত্যাশা, অবশ্যই এই ঐক্য অটুট থাকুক ফ্যাসিবাদ বিরোধী সব শক্তির মাঝে।
তিনি আরও বলেন, গণহত্যার বিচারের আগে কোনো ধরনের নির্বাচন কাঠামোর মধ্যে আমরা ঢুকতে চাই না। একটা পয়েন্ট আছে, এ দেশটাকে একটা মিনিমাম রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মধ্যে নিয়ে যেতে হবে। এটা হচ্ছে আমাদের পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট। যেটা আসলে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও করেছিল। বিএনপি বলি, জামায়াত বলি— সব পলিটিক্যাল পার্টির কিন্তু সেই ২০২৩ সাল থেকে একটা কমিটমেন্ট ছিল।
হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে যারা ছিল তাদের মধ্যে ঐক্য অটুট থাকুক। কারণ পরবর্তী বাংলাদেশকে যদি আমরা বিনির্মাণ করতে চাই তবে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা পোষণে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল একই সুরে কথা বলবে। তবে সব প্রত্যাশা ছাপিয়ে তাদের দাবি অবশ্যই বিচার করতে হবে গণহত্যার।
এদিকে কয়েক বছর ধরে বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল। বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াত ছিল না। তবে আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে দল দুটির সম্পর্কের টানাপোড়েন কিছুটা কমে আসে। দুই দলই আন্দোলনে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর জামায়াত জুলাই অভ্যুত্থানের বড় শক্তি হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছে। সেটিও বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে।
যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চ ও ১২-দলীয় জোটের দুজন নেতা বলেন, নতুন দল গঠনের ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী ভেতরে ভেতরে সহযোগিতা করছে। তারা নির্বাচনী জোট করে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার চিন্তা করছে। মিত্রদের পাশাপাশি বিএনপিও এ ধরনের ধারণা করছে বলে ওই দুই নেতা জানান।
এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও জামায়াত নেতারা বাগযুদ্ধে জড়িয়েছেন। দুইদিন আগে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দলের এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের সমালোচনা করে বলেছেন, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চালাচ্ছে জামায়াত। পাল্টাবিবৃতি দিয়ে এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে জামায়াতও।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেন, মার্চ ফর ইউনিটির কর্মসূচি ফ্যাসিস্টদের জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। এর মধ্য দিয়ে সুযোগ নিয়ে কারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়? শহীদ মিনারে দেওয়া বক্তব্য ও পোস্টার জাতীয় ঐকমত্যে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। গতকাল বুধবার রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে ছাত্রদলের ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনাসভায় তিনি এ মন্তব্য করেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, ২০২৪-এ মানুষের মুক্তির যে সূত্রপাত হয়েছে, তার পূর্ণতা পাক ২০২৫ এসে। এক্ষেত্রে বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের বিকল্প হয়ে উঠতে হবে জনগণকে। তিনি বলেন, এই রাষ্ট্র জনগণের সম্পত্তি, তা জনগণের হাতেই ফিরে আসতে হবে। ২০২৪ সাল হচ্ছে মুক্তির বছর। কিন্তু মুক্তির বিষয়টি তো দুই দিনের ব্যাপার না। এটা মুক্তির সূত্রপাত হলো। দাবি ছিল এর কোনো বিকল্প নাই। জনগণকে এটা প্রমাণ করতে হবে তার একটা বিকল্প আছে। সে বিকল্প হচ্ছে সমগ্র জনগণ। আমরা যেমন এক পরিবারের জায়গায় আরেক পরিবার চাই না,তেমনই এক নেতার পরিবর্তে আরেক নেতাও চাই না। জনগণের যে সম্পত্তি রাষ্ট্র সেটা যেন তাদের হাতে ফিরে আসে। ফ্যাসিবাদী শক্তিকে বাইরে রেখেই জাতীয় ঐক্য সুসংহত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এই মুক্তিযুদ্ধকে যারা বদভাবে ব্যবসায় পরিণত করেছিল, তাদের বাদ দিয়ে ঐক্য করতে হবে। ফ্যাসিবাদকে উৎখাত করার সংগ্রামে যারা যারা সংগ্রাম করেছিল তাদের সবার কণ্ঠস্বর যেন আগামীতে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় থাকে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, গত ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী শাসনের পতনের পর রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য অংশীজন ও ছাত্র-জনতার মধ্যে যে ঐক্য দেখা গিয়েছিল, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে সেই ঐক্যের জায়গায় ইতোমধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। যে একটা অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়েছিল, তাতে ফাটলের পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে নির্বাচনের সময় নিয়ে সন্দেহ। একটি দল গঠনের সুযোগ করে দিতে সংস্কারের নামে সরকার নির্বাচন প্রলম্বিত করতে পারে, এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। এ কারণেই সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। তাই এ বছর রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হতে পারে।
এটিআর/