Logo
Logo

জাতীয়

অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ মাস

বাড়ছে প্রত্যাশা প্রাপ্তির ফারাক

এম এ বাবর

এম এ বাবর

প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:১২

বাড়ছে প্রত্যাশা প্রাপ্তির ফারাক

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার পাঁচ মাস দায়িত্ব পালন করেছে। গণ-অভ্যুত্থানের ঠিক তিন দিনের মাথায় ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন গঠিত এই সরকারের প্রতি তখন সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন দিতে দেখা যায়। একইভাবে দেখা গিয়েছিল রাষ্ট্র সংস্কারের বিপুল প্রত্যাশাও।

অন্যদিকে, ৮ আগস্ট বিপুল জনসমর্থন নিয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে নতুন সরকারের পক্ষ থেকেও রাষ্ট্রসংস্কার, আইনশৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্য, অর্থনীতি, নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে দ্রুত পরিবর্তনের নানান প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পাঁচ মাস পর এসে সরকারের সেসব প্রতিশ্রুতির মধ্যে অনেকগুলোতেই তেমন কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না, যা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। যদিও উপদেষ্টারা বলছেন, একের পর এক আন্দোলন-বিক্ষোভের মধ্যেও তারা লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, যার ফল আগামী এক মাসের মধ্যেই পুরোপুরি দৃশ্যমান হবে।

এদিকে রাষ্ট্রসংস্কারে সরকারের গঠন করা ১১টি কমিশনের ৬টির রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা ছিল চলতি মাসের (জানুয়ারি) প্রথম সপ্তাহে। বাকিগুলোর রিপোর্ট দেওয়ার কথা ফেব্রুয়ারি নাগাদ। কিন্তু প্রথম সপ্তাহে কোনো কমিশনেরই রিপোর্ট জমা হয়নি। তবে সংস্কারে প্রস্তাব তৈরির জন্য প্রথম ধাপে গঠিত ছয় সংস্কার কমিশনের সবগুলোরই মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানানো হয়, জনপ্রশাসন, পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা ও সংবিধান- এসব খাতে পাঁচটি সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় পেল। আর ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনকে।

প্রসঙ্গত, গণঅভ্যুত্থানের এক মাসের মাথায় সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন সংস্কারে ছয়টি আলাদা কমিশন গঠন করে সরকার। পরবর্তীতে এই তালিকায় নতুন আরও চারটি কমিশন যুক্ত করা হয়। সেগুলো হলো- স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন এবং নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন।

অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকেও কেউ কেউ সংস্কার প্রক্রিয়ায় ধীরগতির অভিযোগ তুলেছে। আবার বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দলকে দ্রুত সংস্কার শেষ ও নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিও তুলতে দেখা যাচ্ছে।

জনস্বার্থের বিপরীতমুখী এক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ক্ষমতা গ্রহণের পর যে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে সরকার, সেগুলোর একটি হলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ। 

বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে না রাখতে পারায় আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি মানুষের বড় ধরনের ক্ষোভ জন্মেছিল। আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মানুষের প্রত্যাশা ছিল, বাজারে পণ্যের দাম কমবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম তো কমেইনি, বরং সব কিছুর দাম আরও বেড়ে গেছে বলে অভিযোগ ক্রেতাদের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ হয়েছিল। নতুন সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর সুদের হার বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন করে টাকা না ছাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। এতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও বাজারে সেটার প্রভাব খুব একটা দেখা যায়নি। এমনকি তেল, চিনিসহ আমদানি করা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্কহার কমিয়েও দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারছে না সরকার।

ক্ষমতা গ্রহণের পর পাঁচ মাসে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এখনো সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে সরকার। বিশেষ করে, ৫ আগস্টের পর মাঠে পুলিশের অনুপস্থিতি ও পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ প্রবণতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। একের পর এক ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকাসহ সারা দেশে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সমন্বিত প্রচেষ্টায় সার্বিক পরিস্থিতি বেশ উন্নতি হয়েছে। তবে সন্তোষ প্রকাশ করার অবস্থায় এখনো আসেনি।

এদিকে, দেশে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ লক্ষ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু করেছে। তবে সরকার বলছে, গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন দেওয়া হবে। কিন্তু সংস্কার শেষ হতে কতদিন লাগবে, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের পর নির্বাচনের কথা বলা হলেও বিএনপি চাচ্ছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে ভোট হোক।

অন্যদিকে, শপথ নেওয়ার পর থেকেই অধ্যাপক ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে কাজটি সম্পন্ন করার কথা বলে আসছে, সেটি হলো, জুলাই-আগস্টের ‘গণহত্যার’ বিচার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক তালিকা অনুযায়ী, আন্দোলন চলাকালে তিন সপ্তাহে সাড়ে আটশ’র বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিভাগই মারা গেছেন জ্বলিতে। হত্যার ঘটনায় ইতোমধ্যেই কয়েকশ’ মামলা হয়েছে, যেগুলোতে পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে। শেখ হাসিনাসহ ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ, তাদের জোটসঙ্গীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তবে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করার দাবি সবার।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জোবাইদা নাসরীন বলেন, শেখ হাসিনার পতনের পর মানুষ দ্রুত কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখার অপেক্ষায় ছিল, কিন্তু সরকার তাদের সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি। বিশেষত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকার কার্যকর কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি। ব্যর্থ বলার জন্য এই তিন মাস পর্যাপ্ত না হলেও একেবারে কমও নয়। এ অবস্থায় কতদিন ক্ষমতায় থেকে সরকার কী প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র সংস্কার করতে চায়, সেটি স্পষ্ট করা প্রয়োজন। এতে সরকারের সংস্কার কাজেও গতি আসবে বলে আমি মনে করি।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, মোটা দাগে পাঁচ মাসে সরকার যথেষ্ট অর্জন করেছে। তবে দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসনসহ অনেক ক্ষেত্রেই যে সংকট রয়েছে, সেটি অবশ্য স্বীকার করছেন উপদেষ্টারা। এত কম সময়ের মধ্যে এত সব সংস্কার সম্ভব না। সরকার চেষ্টা করছে এবং ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেটার ফল দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই সংকট আরও কমে আসবে। দৃশ্যমান হবে সংস্কারগুলো।

এটিআর/

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর