Logo

মতামত

বিষের ওপর বিষ গিলছেন ব্যবসায়ীরা

Icon

সাইদ আরমান

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩:০৫

বিষের ওপর বিষ গিলছেন ব্যবসায়ীরা

আমেরিকান চেম্বারের অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীরা আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার তাগিদ দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে হলে, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান একটি অনুষ্ঠানে কথা বলেছেন মঙ্গলবার। তার মতে, দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলছে। তিনি দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কথা বলেছেন। বর্তমান সেনা প্রধান বিচক্ষণ ও দেশ প্রেমিক হিসেবে, সাধারণ মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন। তাই তার বক্তব্য বিশেষ বার্তা বহন করছে দেশের ব্যবসায়ী থেকে সব মানুষের কাছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যা ব্যবসায়ীদের মধ্যে আলোচনা, দেশের এই পরিস্থিতিতে ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তারা কি বিনিয়োগ ঝুঁকি নেবেন? কোনো বিনিয়োগকারীই তা নেবেন না। আমি ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্বেগের সঙ্গে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাই, ব্যাংক ঋণের সুদহার নিয়ে। অবশ্যই ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি একটি দেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে শিল্প, ব্যবসা ও বাণিজ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে, যেখানে কিছু দিন আগে ঋণের সুদের হার ছিল ৯ শতাংশ এবং এখন তা বেড়ে ১৬ শতাংশেরও বেশি হয়ে গেছে, তার ফলাফল অনেকটা অস্থিতিশীল হতে পারে। 

যখন ঋণের সুদ বাড়ে, তখন ব্যবসা এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে বেশি খরচ করে। অর্থাৎ, যে পুঁজির জন্য আগে তারা কম সুদ দিত, এখন তা তাদের জন্য অনেক বেশি হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ঋণের সুদ বৃদ্ধি ব্যবসার জন্য একটি চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করেছে। কারণ বেশি সুদ মানে বেশি খরচ, যা ব্যবসার লাভের পরিমাণকে সংকুচিত করতে পারে। বিশেষত, ছোট ও মাঝারি আকারের ব্যবসাগুলোর জন্য এটি আরও বেশি ক্ষতির। 

সুদ হার বাড়ানোর ফলে ব্যবসায়িক বিনিয়োগে প্রভাব পড়ে। ব্যবসাগুলো যদি ঋণ নিয়ে নতুন প্রকল্প শুরু করতে চায়, তবে উচ্চ সুদের কারণে তারা নতুন বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নাও হতে পারে। এটি মূলত দুইভাবে কাজ করে। প্রথমত, উচ্চ সুদের কারণে ঋণ নেওয়ার খরচ বেড়ে যায়, ফলে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যায়; দ্বিতীয়ত, ব্যবসার মুনাফা যেহেতু কমে, যার ফলে ভবিষ্যতে আরও বিনিয়োগ করার আগ্রহ হারাতে শুরু করেছেন উদ্যোক্তারা। এসব কিন্তু একটি বড় অস্বস্তি তৈরি করবে। ঋণের সুদ বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন শিল্প খাতে কাজ করা মানুষের জন্যও কিছুটা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতে পারে। ব্যবসায়িক অস্থিরতার কারণে ভবিষ্যতে কর্মী ছাঁটাই কিংবা কর্মঘণ্টা কমে যেতে পারে, যা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করবে বলে ধরে নেওয়া যায়। স্থানীয় ব্যবসার বাইরে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও হোঁচট খাবে এই উচ্চ সুদের সময়কালে। বাংলাদেশ একটি রপ্তানিমুখী অর্থনীতি। সুদের হার বাড়া মানে, রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ নেওয়ার খরচ বাড়িয়ে দেয়, যা তাদের উৎপাদন খরচ বাড়াবে দিনশেষে। এটি যে এখানেই শেষ হয়ে যাবে তা নয়, এর ফলে তাদের পণ্যগুলোর দাম বাড়তে পারে। যা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা কমিয়ে দেবে। রপ্তানি কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। 

ঋণের সুদ বাড়ার কারণে বিনিয়োগ কমে গেলে উৎপাদন ক্ষমতা কমতে পারে, যার ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে পারে। যখন ব্যবসাগুলো উৎপাদন কমাবে বা নতুন বিনিয়োগে না যাবে, তখন পণ্যের সরবরাহ কমে যেতে পারে এবং এতে পণ্যের দাম বাড়বে। এর ফল স্বরূপ, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেতে পারে, যা সাধারণ জনগণের জীবিকা নির্বাহে চাপ সৃষ্টি করে। আপনার আমার জীবনও কিন্তু রেহাই পাবে না। কারণ যখন সুদের হার বাড়ে, তখন ব্যবসাগুলো তাদের উৎপাদন খরচ পুরণ করতে পণ্য দাম বাড়িয়ে দিবে বা দিচ্ছে। যখন সুদের হার বাড়ে, ঋণগ্রহীতাদের জন্য মাসিক কিস্তির পরিমাণও বাড়তে পারে। বিশেষত, ছোট বা মাঝারি আকারের ব্যবসাগুলোর জন্য এটি একটি বড় চাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তারা যখন তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে প্রয়োজনীয় অর্থ সংকুলান করতে পারে না, তখন তাদের জন্য ঋণ পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই অবস্থায়, অনেক সময় তারা ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়, যার ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়তে পারে। যা এরই মধ্যে পাহাড় সমান, ছাড়িয়ে গেছে তিন লাখ কোটি টাকা। উচ্চ সুদের হার যে কোনো ঋণগ্রহীতার জন্য একটি অপ্রত্যাশিত খরচ বাড়াচ্ছে বলে সবাই মনে করছেন। যদি কোনো ব্যবসা বা ব্যক্তি ইতোমধ্যে সীমিত লাভের মধ্যে কাজ করে থাকে, তবে তাদের জন্য সুদ বৃদ্ধি নতুন আর্থিক চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করেছে, এটি অনেকটা নিশ্চিত। এই পরিস্থিতিতে, তারা সম্ভবত তাদের ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করতে অক্ষম হবে। আর যেসব প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই আর্থিকভাবে দুর্বল অবস্থানে আছেন, তাদের জন্য সুদের হার বৃদ্ধি একটি বড় ধাক্কা হতে পারে। 

সুতরাং, এটি খুবই স্পষ্ট ঋণের সুদের হার যে হারে বাড়ছে, তাতে নতুন করে অনেক প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়ে পড়বে। এ ছাড়া মুদ্রাস্ফীতি এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ার সম্ভাবনাও থাকতে পারে, যা সাধারণ মানুষের জন্য জীবনযাত্রার খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই ঋণের সুদের হার নিয়ন্ত্রণে রাখাটা দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে জরুরি। আমরা দেখছি, দেশের ব্যবসা বাণিজ্য নানা ঝুকি পাড় করছে। তার মধ্যে নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াও চলছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গতকাল গনশুনানী করেছে। মনে রাখতে হবে, ব্যবসায়ীরা বিষের ওপর বিষ গিলছেন, যা' কর্মসংস্থান ও সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য কালো মেঘ। 

লেখক: বিশেষ প্রতিবেদক, নাগরিক টেলিভিশন 

বিএইচ

 

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর