-67ca688546666.jpg)
পরের প্রজন্মটাকে আমরা হাতে ধরে অস্থির করে তুলছি। সকাল থেকে রাত, তাদেরকে কী দিচ্ছি আমরা? একটা ৩-৪ বছরের শিশু দিনের অর্ধেক বা আরও বেশি সময় পার করছে মোবাইল বা ট্যাব নামক বস্তুর কয়েক ইঞ্চি স্ক্রিনে। বড়জোর টিভি বা ল্যাপটপের স্ক্রিনে। আকাশ ওরা দেখে ঠিকই, তবে ঐ স্ক্রিনের ভেতরে—এনিমেটেড আকাশ, প্রজাপতি, ফুল-পাখির সাথে পরিচয় হলেও জানালার বাইরের মুক্ত আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকানো তেমন হয়ে ওঠে না। সেই পরিবেশ এবং উৎসাহ দেওয়া হয় না ওদেরকে।
স্ক্রিনে যে গেমস বা ভিডিওগুলোতে মেতে থাকছে সারাটা সময়, সেখানে অধিকাংশ উপাদান সহিংসতা ও বিভৎসতায় ঠাসা। যুদ্ধ, মারামারি, হত্যা—অন্যকে মেরে নিজের পক্ষের চরিত্রকে বিজয়ী করার খেলা খেলতে খেলতে বাস্তব জীবনেও ওরা ওরকম হয়ে ওঠে। ঐ চরিত্রগুলো থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারে না। কী শিখতে শিখতে বড় হচ্ছে ওরা? কেবল প্রতিযোগিতা, কেবল নিজেকে বিজয়ী করা, তার জন্য প্রয়োজনে আর সবাইকে মেরে ফেলে সব কিছু ধ্বংস করেও নিজেকে সেরা প্রমাণ করা! এই তো আজকের দিনের চর্চা হয়ে উঠছে। এমনকি পড়াশোনাতেও তো এই প্রতিযোগিতা আর বিজয়ী হওয়ারই লড়াই। অভিভাবকরাও সকলে মিলে সন্তানদেরকে প্রতিযোগিতার রিলে দৌড়ে নামিয়ে দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি!
আপনি আমি নানান সময় বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির বুলি আওড়িয়ে মুখে ফেনা তুললেও বাসায় যে টেলিভিশনটি রয়েছে সেখানে সকাল হতেই বিদেশি চ্যানেল চলতে শুরু করে, বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত হয়ত কখনও চ্যানেল বদলাতে গিয়ে ভুলে দু-একটি বাংলা চ্যানেলে কয়েক সেকেন্ড চোখ যায়, কিন্তু মন বিদেশিতেই থাকে। গান শুনতে পছন্দ করেন বেশিরভাগ মানুষই। কিন্তু আজকাল আমাদের ভাবটা এমন যে, বাংলাদেশে, বাংলা ভাষায় তো আর ভালো গান হয় না তেমন। তাই বিদেশিই ভরসা!
আবার স্বাভাবিক মাত্রার খোলা শব্দে গান শোনার অভ্যাস কমছে। কানের মধ্যে হেডফোন বা এয়ারফোন গুঁজে দিয়ে গান শুনতে হয় আজকাল, সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, একা একা। তরুণদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি হলেও শিশু-কিশোরেরাও অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে এতে। আরেকদল অবশ্য শুনছে অতি উচ্চ শব্দে। তাতেও অধিকাংশের পক্ষে অংশ নেওয়া সম্ভব হয় না।
আমার দেশের মাটি-বাতাস-আলোর থেকে যে গান-সুর-খেলা উৎসারিত, সেসবে আর রুচি নাই আমাদের। সব হতে হবে গতিময় ভীনদেশি আদলের।
নিজের দেশকে না চিনে এসব নানান মাধ্যমে অন্য দেশের মানুষের সংস্কৃতি আর জীবনযাপন দেখে-শুনে ভেতরে ভেতরে একরকম অস্থিরতা তৈরি হয় বলেই আমার মনে হয়। বড়দেরই হয়, শিশু-কিশোরদের মন তো নরম, কাদা-মাটির মতো, সেই মনে জটিলতা বাড়ারই কথা।
সমাধান বা মুক্তির উপায় আছে কি?
এই যে অবস্থা, তার দায় এককভাবে কারো নয়। পুরো ব্যবস্থাটাই এভাবে চলেছে। অধিকাংশই সেই চলমান ব্যবস্থার স্রোতে গা ভাসানোর বিকল্প খুঁজে বুঝে পাই না আর। এই ব্যবস্থা পরিবর্তন বা উন্নয়নের মূল দায়িত্ব নিশ্চিতভাবেই রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে শিশুর শৈশব যাপনের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমাদের রাষ্ট্র আজ পর্যন্ত শিশুদের জন্য যথাযথভাবে ভাবেনি। কিন্তু তাই বলে ব্যক্তি পর্যায়ে নিজেদের দায়ও আমরা এড়াতে পারি না। আমার সন্তানের প্রতি আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসা তো আর কারো থাকতে পারে না। তার ভালোর জন্য স্রোতের বিপরীতেও ভাবতে হবে প্রয়োজনে। সেইটুকু মনোযোগ আমরা দেই না। কিন্তু ভালো চাইলে, সন্তান, মানুষ, সমাজ ও দেশের ভালো চাইলে নিজের জায়গা থেকে উদ্যোগী হয়ে উপায় খুঁজতে হবে।
শিশুদের হাতে মোবাইল, ট্যাব বা ল্যাপটপ দেওয়ার আগে সময় নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। বয়সভেদে দিনে সর্বোচ্চ ৩০-৬০ মিনিটের বেশি নয়। পরিবারে অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে—শুধু শিশুদের উপর বিধিনিষেধ চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের সময়টুকু স্ক্রিনে ব্যয় করলে ওরা শিখবে কীভাবে?
এসব ডিভাইসে ওরা কী করছে, কী দেখছে, কী খেলছে তা খেয়াল রাখতে হবে। এমন অ্যাপ বা গেমে উৎসাহ দিতে হবে যা ওদের সৃজনশীলতা বাড়ানোতে ভূমিকা রাখতে পারে। সহিংসতা আছে এমন সবকিছুতে কড়াভাবেই বাধা দিতে হবে, এমনকি তাতে কখনো ওদের মন খারাপ হলেও।
শিশুদের প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। তাদের নিয়ে মাঠে খেলতে যাওয়া, গাছে পানি দেওয়া, পাখির ডাক শোনানো—এসব অভ্যাস তৈরি করা জরুরি। ছুটির দিনে বাচ্চাদের নিয়ে গ্রামের বাড়ি বা প্রকৃতির কাছাকাছি কোথাও ঘুরতে যাওয়া যেতে পারে।
বাসায় বাংলা গান শোনা, গল্প ও কবিতা পড়া বা আবৃত্তি চর্চা ইত্যাদি একসময় এদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের অপরিহার্য উপাদান ছিল। আজকের আধুনিক ডিভাইসগুলোতেও দেশীয় গান, আবৃত্তি বাসায় দিনের কিছু সময় বাজিয়ে রাখা যেতে পারে। তাতে শিশুদের শোনার কান ও মন তৈরি হবে আপনা-আপনি।
আমাদের সন্তানদের আমরা কীভাবে বড় করছি? কী পরিবেশ দিচ্ছি ওদের? এসব নিয়ে ভাবনার অভিনয় থাকলেও সত্যিই কি ভাবছি আমরা? যদি ভাবতাম, তাহলে নিজেদের ঘরে কী পরিবর্তন এনেছি ওদের জন্য? কী চেষ্টাটুকু করেছি? প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হবে আমাদের নিজেদের কাছেই। কারণ ভবিষ্যৎ গড়তে হলে বর্তমানেই উদ্যোগ নিতে হয়। সন্তানদের শুধু প্রযুক্তির হাতে ছেড়ে দিয়ে নয়, তাদের উপযুক্ত দিকনির্দেশনা দিয়ে, দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে এবং প্রকৃতির সংস্পর্শে রেখে আমরা তাদের জন্য এক সুন্দর আগামী তৈরি করতে পারি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে আমরা কী তুলে দিচ্ছি, তার উপরই নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ সমাজের চেহারা। এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়—আমরা কী চাই? এক বিকৃত, সহিংস, বিচ্ছিন্ন প্রজন্ম, নাকি এক সুস্থ, সংবেদনশীল, চিন্তাশীল ও সৃজনশীল ভবিষ্যৎ?
সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে।
মেহেদী হাসান শোয়েব : লেখক, প্রকাশক, বিতার্কিক; শিফট ইনচার্জ, বাংলাদেশের খবর
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com
এমএইচএস