
গাজা উপত্যকা আবারও রক্তে ভাসছে। ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত বোমাবর্ষণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে খান ইউনিস, রাফা ও গাজার আরও বহু এলাকা। বিধ্বস্ত ভবনগুলোর নিচে চাপা পড়েছে শত শত মানুষ, কেউ হয়ত তখনও জীবনের জন্য ছুটছিল, কেউ হয়ত ঘুমিয়েছিল নির্ভাবনায়। সম্প্রতি এক গভীর রাতে শুধু এক হামলাতেই ৪০৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। মৃতদের মধ্যে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরাই বেশি। বহু পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, বাবা-মা হারিয়েছে সন্তানকে, ভাই হারিয়েছে বোনকে, কেউ কেউ আবার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে এখনো মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। চারদিকে শুধুই ধ্বংসের স্তূপ, রক্তমাখা পথঘাট, ধূলার আস্তরণে ঢেকে যাওয়া শহর—যেখানে বাতাসে মিশে আছে মৃত্যুর গন্ধ। হাসপাতালগুলোতে জায়গার অভাবে আহতদের মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, রক্তাক্ত শিশুদের কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়তে দেখা যায়। কিন্তু সাহায্যের জন্য চিৎকার করলেও কোনো উত্তর নেই, মানবতার পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেই। এ যেন এক বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্ন, যা ফিলিস্তিনের মানুষের জন্য প্রতিদিনের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে প্রতিটি ভোর মানে নতুন শোক, নতুন লাশ, নতুন ধ্বংসস্তূপ—আর বিশ্ব শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে।
কতদিন চলবে এই হত্যাযজ্ঞ?
গাজা রক্তাক্ত। ইসরায়েল বলছে, তারা ‘পূর্ণশক্তির যুদ্ধের পুনরারম্ভ’ করেছে। হামাস এটিকে বলছে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’। কিন্তু এই রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কূটচালের বাইরেও আছে মানবিকতার প্রশ্ন—একটি জাতিকে এভাবে নিশ্চিহ্ন করার অধিকার কারো আছে কি? কতদিন ধরে এই নিষ্ঠুরতা চলতে থাকবে? প্রশ্নটা শুধু ফিলিস্তিনের নয়, এটা পুরো মানবতার প্রশ্ন। প্রায় আট দশক ধরে ফিলিস্তিনি জনগণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। ১৯৪৮ সালে দখলদারিত্বের মাধ্যমে যে অন্যায় শুরু হয়েছিল, তার অবসান তো হয়নি; বরং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। প্রতিটি হামলার পর পশ্চিমা বিশ্ব ও জাতিসংঘ কিছু নিন্দার বিবৃতি দেয়, মুসলিম বিশ্ব উদ্বেগ প্রকাশ করে, এরপর সব আগের মতোই চলতে থাকে। এই চক্র কি কখনো ভাঙবে? নাকি প্রতিবারের মতোই গাজায় বোমা পড়বে, শিশুরা মরবে, ভবন ধসে যাবে, পরিবার নিশ্চিহ্ন হবে, আর আমরা নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকব? পৃথিবীর বিবেক কি একবারের জন্য হলেও জেগে উঠবে, নাকি শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে ফিলিস্তিনিরা হারিয়ে যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর যদি আজ না খুঁজে বের করা হয়, তাহলে হয়ত একদিন ফিলিস্তিন মানচিত্র থেকেই হারিয়ে যাবে। তখন কী বলবে ইতিহাস?
নীরবতা কি ইসরায়েলকে আরও উগ্র করছে?
জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং তথাকথিত বিশ্বশক্তিগুলো কি দেখতে পাচ্ছে না, কী হচ্ছে গাজায়? অবশ্যই দেখছে, কিন্তু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস তাদের নেই। বরং তারা 'উভয় পক্ষকে সংযত হওয়ার আহ্বান' জানিয়ে দায়সারা বক্তব্য দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করে। এই নীরবতা আসলে ইসরায়েলকে আরও উগ্র করে তুলছে। তারা জানে, তাদের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো শক্তিধর রাষ্ট্র রয়েছে। তারা জানে, যতই হত্যাযজ্ঞ চালাক, বড়জোর কিছু দেশ 'উদ্বেগ' প্রকাশ করবে, কিছু জায়গায় বিক্ষোভ হবে, এরপর সব আবার আগের মতোই চলবে।
প্রশ্ন হলো, এই নিস্ক্রিয়তা কি শুধু ইসরায়েলের দোষ? না, এই দায় পুরো বিশ্বব্যবস্থার, যেখানে মানবাধিকারের নামে পক্ষপাতিত্ব চলে, যেখানে কিছু জাতির জীবন-মৃত্যু গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু জাতির মৃত্যু কেবল পরিসংখ্যানে ঠাঁই পায়। যদি বিশ্বনেতারা সত্যিই ন্যায়বিচারের পক্ষে থাকত, তবে এতদিনে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতো, সামরিক সহায়তা বন্ধ করা হতো, দখলদারিত্বের অবসান ঘটত। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। বরং প্রতিবারের মতোই ফিলিস্তিনিরা মরছে, ঘরবাড়ি ধ্বংস হচ্ছে, জাতিসংঘ বিবৃতি দিচ্ছে, আর বিশ্ব চুপচাপ দেখছে। এই নীরবতা কি একদিন মানবতার চূড়ান্ত পতনের সাক্ষী হবে না?
ফিলিস্তিনিদের অপরাধ কী?
প্রশ্ন জাগে, ফিলিস্তিনিরা কী দোষ করেছে? কেন তাদের এই ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে? তাদের অপরাধ একটাই—তারা দখলদারদের বিরুদ্ধে মাথা নত করেনি। তারা তাদের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, যা পশ্চিমাদের চোখে ‘সন্ত্রাসবাদ’ হিসেবে চিত্রিত হচ্ছে। অথচ যখন ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে, তখন সেটাকে ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলা হয়! এটাই বাস্তবতা—বিশ্বের মানবাধিকারের সংজ্ঞা পরিস্থিতি ও স্বার্থের ওপর নির্ভর করে বদলে যায়। ফিলিস্তিনিরা প্রতিদিন নিপীড়ন, নির্যাতন, অবরোধ আর হত্যা সহ্য করলেও, বিশ্ববাসী যেন সেটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি বোমায় উড়িয়ে দেওয়া হয়, হাসপাতাল লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়, শিশুদের হত্যা করা হয়—কিন্তু তারপরও পশ্চিমারা নির্লজ্জভাবে ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ নিয়ে কথা বলে। এই দ্বিচারিতা কি চিরকাল চলবে? নাকি একদিন বিশ্ববিবেক জাগবে? ফিলিস্তিনিরা শুধু তাদের স্বাধীন ভূখণ্ড চেয়েছে, মুক্তভাবে বাঁচার অধিকার চেয়েছে—এটাই কি তাদের বড় অপরাধ?
মুসলিম বিশ্ব কি আজও নীরব থাকবে?
ইসরায়েলের এই দখলদারিত্ব ও হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ আসা উচিত মুসলিম বিশ্ব থেকে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মুসলিম দেশগুলো নিজেদের স্বার্থের কারণেই নীরব। কিছু দেশ হয়ত কৌশলগত কারণে প্রকাশ্যে নিন্দা জানায়, তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ তারা নেয় না। অথচ ইসলামের মূল শিক্ষা হলো—অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। প্রশ্ন হলো, মুসলিম বিশ্ব কি শুধুই নিন্দার বিবৃতি দিয়েই দায় সারবে? ফিলিস্তিনের ভাই-বোনরা যখন প্রতিদিন বোমার নিচে ধ্বংস হচ্ছে, শিশুরা যখন রক্তাক্ত হয়ে মায়ের কোলে নিথর হয়ে পড়ছে, তখনও কি মুসলিম শাসকেরা কেবল নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকবে? তাদের কি মনে হয় না, ফিলিস্তিনের ওপর এই নিপীড়ন একদিন তাদের দেশেও আসতে পারে?
আরব দেশগুলোর অনেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে, বাণিজ্য চুক্তি করেছে, অথচ ফিলিস্তিনিদের জন্য তারা কিছুই করছে না। মুসলিম বিশ্ব কি নিজেদের ভ্রাতৃত্ব ভুলে গেছে? যদি মুসলিম উম্মাহ এক হয়ে দাঁড়ায়, তবে এই জুলুম থামানো সম্ভব। এই প্রশ্ন মুসলিম বিশ্বকে নিজেকেই করতে হবে—আমরা কি কেবল বিবৃতি দিয়েই দায় সারব, নাকি বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেব? মুসলিম শাসকেরা যদি আজও ঘুমিয়ে থাকে, তাহলে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না।
একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার এই প্রক্রিয়া আর কতদিন?
গাজার শিশুরা যখন সেহরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখনই বোমারু বিমানগুলো আকাশ কাঁপিয়ে বোমা ফেলল। মুহূর্তেই ভবন ধসে পড়ল, ধুলোর মধ্যে চাপা পড়ল শত শত মানুষ। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে একটি পরিবার, একটি ভবন, একটি পাড়া—সব ধ্বংস হয়ে গেল। ধোঁয়া আর ধুলোর আস্তরণে ঢেকে গেল আকাশ, বাতাস ভারী হয়ে উঠল আর্তনাদে। এক মুহূর্ত আগেও যারা জীবিত ছিল, স্বপ্ন দেখছিল, কথা বলছিল—তারা এখন নিথর, নিশ্চুপ। কিন্তু প্রশ্ন একটাই—এই নিষ্ঠুরতা আর কতদিন চলবে? আমরা কি কেবল সংবাদ দেখে শিউরে উঠব? কেবল সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দিয়ে বিবেককে সান্ত্বনা দেব? নাকি সত্যিই কিছু করার সময় এসেছে?
বিশ্ব কি আজও নীরব থাকবে? নাকি ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াবে? ইতিহাস সাক্ষী, দখলদাররা কখনো স্বেচ্ছায় থামে না—তাদের থামাতে হয়। আজ যদি বিশ্ব কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে শুধু ফিলিস্তিন নয়, অন্যায় ও দখলদারিত্বের এই সংস্কৃতি আরও বিস্তৃত হবে। ইসরায়েল জানে তাদের এই হত্যাযজ্ঞের কোনো জবাবদিহিতা নেই। বরং তাদের পক্ষে রয়েছে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর মদদ। মানবাধিকারের বুলি আওড়ানো পশ্চিমা বিশ্ব ফিলিস্তিনিদের বেলায় সেই মানবাধিকারের প্রয়োগ ভুলে যায়। তাহলে কি ইতিহাসের পাতায় আরও একটি কালো অধ্যায় যোগ হবে—আর আমরা কেবল চেয়ে চেয়ে দেখব? ন্যায়বিচার কি হারিয়ে যাবে শক্তির দম্ভের কাছে? ফিলিস্তিনের নিরীহ শিশুদের রক্ত কি একবারও বিশ্ব বিবেককে কাঁপিয়ে তুলবে না?
সুদীপ্ত শামীম : গণমাধ্যমকর্মী, কলামিস্ট ও সংগঠক
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com
এমএইচএস