-67dd16b8ec54f.jpg)
পিআর সিস্টেমে নির্বাচন (Proportional Representation) নিয়ে রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। ৫ আগস্টের পর থেকে বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে এক প্রকার বাগ্বিতণ্ডা চলছে পিআর বা সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচন নিয়ে। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি একটি বড় দল, এটা যে কাউকে স্বীকার করতেই হবে। রাজনীতিতে তাদের অবদান কোনো অংশে কম নয়। তবে পিআর সিস্টেমের নির্বাচন নিয়ে বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল পুরোপুরি বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে।
বিএনপির পর রাজনীতিতে আলোচিত রাজনৈতিক সংগঠন হলো জামায়াত এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ একপ্রকার অনিশ্চিত। এমন বাস্তবতায় রাজনীতির মাঠে মূলত তিনটি দলই ব্যাপকভাবে আলোচনায় রয়েছে। বিএনপি বড় দল হিসেবে আগামীতে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার আশা নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় মাঠে সরব। অপরদিকে, তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াত এখন বিএনপির বিপরীতমুখী নীতিতে রাজনীতি করছে। এদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ পূর্বে কোনো জোটে না থাকলেও বর্তমানে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে একটি জোট করার চেষ্টা করছে। বিএনপির সাথে কিছু ছোট ছোট রাজনৈতিক দল থাকলেও বিএনপির বলয়ের বাইরে রাজনৈতিক দলের একটি বড় অংশ পিআর তথা সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। প্রথমদিকে জামায়াত পিআর সিস্টেমে নির্বাচনের পক্ষে না থাকলেও গত নভেম্বর থেকে তারাও পিআর সিস্টেমে নির্বাচনের দাবি সভা-সমাবেশে তুলে ধরছে।
পিআর সিস্টেমে নির্বাচনের দাবি প্রথম আলোচনায় আনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ২০২২ সালের জাতীয় মহাসমাবেশে সর্বপ্রথম রাজনীতিতে পিআর সিস্টেমে নির্বাচনের দাবি তোলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাইর পীর মুফতি সৈয়দ রেজাউল করিম। তখন সেটা ততটা আলোচিত হয়নি। ৫ আগস্টের পর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সারা দেশে এই দাবিতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গণসমাবেশ করেছে। এরপর থেকে জামায়াত, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, গণঅধিকার পরিষদ, সিপিবি, বামজোট, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, এবি পার্টিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল পিআর সিস্টেমে নির্বাচন নিয়ে সরব হয়। পিআর সিস্টেমে নির্বাচনের দাবি জোরালো হলে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, পিআর সিস্টেমে নির্বাচন মানে হলো আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করা।
এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের ১৭০টি দেশের মধ্যে ৯১টি দেশে পিআর সিস্টেমে নির্বাচন হয়। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশসহ ইউরোপ ও উন্নত দেশগুলোতে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়। আরেক জরিপে উঠে এসেছে, প্রচলিত পদ্ধতিতে (First-Past-The-Post Voting - FPTP) নির্বাচনে ৬০% ভোট মূল্যহীন হয়ে যায়। প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে না, তবে পিআর সিস্টেমে নির্বাচন হলে জনমতের যথাযথ প্রতিফলন ঘটে এবং সংসদে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
পিআর বা সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচনের গুরুত্ব
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে পিআর সিস্টেমে নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পিআর সিস্টেমে নির্বাচন হলে সংসদে কোনো দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে না। যেহেতু ভোটের হার অনুসারে আসন বরাদ্দ হবে, তাই অতীতের মতো একক ক্ষমতা পেয়ে কেউ স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারবে না। বিএনপির পিআর সিস্টেমের বিরোধিতার অন্যতম কারণ হতে পারে সংসদে তাদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা। পিআর সিস্টেমের নির্বাচন হলে প্রায় সব রাজনৈতিক দল সংসদে কম-বেশি আসন পাবে।
বিগত চারটি জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে—
- ১৯৯১ সালে বিএনপি ভোট পেয়েছিল ৩০.৮১% এবং আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩০.০৮%।
- ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩৭.৪৪% এবং বিএনপি পেয়েছিল ৩৩.৬১%।
- ২০০১ সালে বিএনপি পেয়েছিল ৪০.৮৬% এবং আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪০.২১%।
- ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪৯% এবং বিএনপি পেয়েছিল ৩৩.২০% ভোট।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন এবং বিএনপি মাত্র ৩০টি আসন পেয়েছিল। পিআর সিস্টেমে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের আসন কমে দাঁড়াত ১৪৭টিতে এবং বিএনপির আসন বেড়ে দাঁড়াত ৯৯টিতে। সুতরাং, এটা স্পষ্ট যে পিআর সিস্টেমে নির্বাচন হলে বড় দলগুলোর আসন কমবে এবং ছোট দলগুলোর আসন বাড়বে। সম্ভবত এই কারণেই বিএনপি পিআর সিস্টেমের নির্বাচন চায় না।
বিএনপির বিপরীতে জামায়াত-ইসলামী আন্দোলন কতটা সফল হবে?
দেশের প্রধান এবং বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা পিআর সিস্টেমে নির্বাচন চায় না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পিআর সিস্টেমে নির্বাচন দাবি করা জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো বিএনপির বিপরীতে এই দাবি আদায় করতে পারবে কিনা। যদি বিএনপি সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচনের দাবির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাহলে যারা পিআর সিস্টেমে নির্বাচন চায়, তারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
জামায়াত এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মধ্যে আকিদাগত বিরোধ দীর্ঘদিনের। তবে বর্তমানে দল দুটির মধ্যে অনেকটা সম্প্রীতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এখন প্রায় নেই বললেই চলে। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ভোটের জোট করবে কি না, সেটি অন্য বিষয়। তবে তারা মিলে ছোট ছোট দলগুলোকে একত্রিত করে পিআর সিস্টেমে নির্বাচন আদায়ে সোচ্চার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এটি যুগপৎ আন্দোলন বা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হতে পারে।
জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদের মধ্যে ঐক্যের আলোচনা চলছে। সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচনের দাবিতে ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে পারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, নাগরিক কমিটি, সিপিবি, গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও বামজোট। যদিও ইসলামী দল ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শিক মতপার্থক্য রয়েছে, তবুও পিআর সিস্টেমে নির্বাচনের দাবিতে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। বিএনপির বিরোধিতা এখানে বুমেরাং হতে পারে।
নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণার পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হতে পারে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচন হলে দেশে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও সমাজকর্মী
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com
এমএইচএস