নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে বড় গণআন্দোলনটি সংঘটিত হয়েছে জুলাই-আগস্টে। এর ফলে স্বৈরশাসনের অবসান হয়। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন। ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ শপথ গ্রহণ করে। এতে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগে সবার মধ্যে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মানুষ একটা বন্দিদশার মধ্যে ছিল। কিছু বললেই জামাত-শিবির ট্যাগ দেওয়া হতো। মানুষের বাকস্বাধীনতা ছিল না। টুটি চেপে ধরার সংস্কৃতি জারি ছিল। এ ছাড়া নির্যাতন-হেনস্তায় প্রায় ‘একঘরে’ করে রাখা হয়েছিল বিরোধী মতাদর্শের মানুষজনকে। মানুষের প্রায় সব ব্যাপারেই তাদের আপত্তি ছিল, হস্তক্ষেপ ছিল। মনে হচ্ছিল, দেশটা আওয়ামী লীগের গুটিকয়েক নেতাকর্মীর সম্পদ। যার ফলে তাদের পতনে মানুষের মনে ঈদের খুশি বিরাজ করেছিল। মানুষ ভেবেছিল, আর কোনো কর্তৃত্ববাদী গোষ্ঠী এদেশে মাথাচাড়া দিতে পারবে না। নতুন বাংলাদেশে সে সুযোগ দেবে না ছাত্র-জনতা। সম্মিলিতভাবে সব রকমের নৈরাজ্য রুখে দেওয়া হবে।
কিন্তু সংস্কারের পর যে ‘নতুন বাংলাদেশের মুখ’ দেখার আশা, তার আগে আমরা ‘আপত্তির মুখ’ দেখতে শুরু করেছি। একটা গোষ্ঠী তাদের ‘আপত্তির মুখ’ দেখাচ্ছে, রাষ্ট্রকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে। অথচ তাদের যেসব বিষয়ে আপত্তি, সেসব বিষয়ে রাষ্ট্রীয় কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবু তারা গানের অনুষ্ঠান পণ্ড করার সাহস দেখাতে পেরেছেন। গত ২১ ও ২২ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জে ‘লালন মেলা’ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের আপত্তির মুখে বন্ধ হয় মেলাটি। হেফাজত নেতারা হুমকি দিয়েই মেলা বন্ধ করতে বাধ্য করেছেন আয়োজক কর্তৃপক্ষকে।
হেফাজতের এক নেতার বক্তব্যটা একটু কোট করলে তাদের আগ্রাসী রূপের হদিস পাওয়া যাবে। দলটির কেন্দ্রীয় নায়েবে মাওলানা আব্দুল আউয়াল বলেন, 'প্রশাসনকে বলব, এখানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যেতে পারে। মুসলিম তৌহিদী জনতা আপস করতে রাজি না। প্রয়োজনে আমরা হাত দিয়ে বাধা দিব। যা কিছু এখানে হচ্ছে, এগুলো বন্ধ করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই যেন এটা না হয়। অপ্রীতিকর কিছু হলে তার দায়ভার আপনাদের নিতে হবে।' (বক্তব্য, টিবিএস বাংলা, ২১ নভেম্বর)।
‘আমরা হাত দিয়ে বাধা দিব’- এ ধরনের আধিপত্যের বিরুদ্ধেই ২৪-এর গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ছাত্ররা যখন যৌক্তিক কোটা সংস্কারের দাবিতে মাঠে নেমেছিল, তখন ছাত্রলীগ হামলার মাধ্যমে তা দমন করার চেষ্টা করে। কিন্তু এর ফল ভালো হয়নি। আওয়ামী লীগ আজ বাংলাদেশে নিজেদের চেহারাই দেখাতে পারছে না। লুকিয়ে লুকিয়ে থাকছে, বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তাদের নেতাকর্মীরা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ধর্মভিত্তিক দল আধিপত্যবাদী নীতি গ্রহণ করেছে। যদিও তারা আগেও এমনই ছিল। কিন্তু কথা হলো, এখন গণঅভ্যুত্থানের নতুন বাংলাদেশে কেন তাদের চিন্তাধারার পরিবর্তন হচ্ছে না? এখন তো সবকিছুতেই পরিবর্তনের হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। এই সময় কেন তারা ‘প্রয়োজনে আমরা হাত দিয়ে বাধা দিব’ বলবে? এই প্রশ্ন আমাদের সমন্বয়ক ছাত্রনেতারাও করছেন না। অথচ নতুন বাংলাদেশে তারা যেকোনো আধিপত্যবাদ রুখে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। এ নিয়ে তাদের যেন মাথাব্যথা নেই!
অন্তর্বর্তী সরকারও হেফাজতের এসব দারোগাগিরির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। জ্ঞাতে কি অজ্ঞাতে এড়িয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু সরকারকে ভুলে গেলে চলবে না যে, তাদের প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম হচ্ছে। মানুষের ধর্মীয়, মতাদর্শিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার হরণ করা হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। মানুষকে ক্ষেপানোর ফল ভালো হয় না। পরে দেশটা অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে।
হেফাজতের এমন ঔদ্ধত্যমূলক কাজ-কারবার ও বক্তব্য ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ জুলাইয়ে সব ধর্ম ও মতাদর্শের মানুষ স্বৈরাচার হটানোর আন্দোলনে নেমেছিল। সবারই আকাঙ্ক্ষা ছিল নতুন বাংলাদেশের। কিন্তু নতুন বাংলাদেশে যদি ধর্মীয় খোলসে আধিপত্যবাদ মাথাচাড়া দেয়, তাহলে সেটা মেনে নেওয়া যায় না।
এর আগে সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে দেশের বিভিন্ন মাজারে হামলা হয়েছে। এসব হামলা-ভাঙচুরে নেতৃত্বে ছিলেন ইসলামি দলের নেতাকর্মীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের উসকানিমূলক বক্তব্যও পাওয়া যায়। তারা জোরপূর্বক গান-বাজনা ও উরস বন্ধ করে মাজার ‘শুদ্ধিকরণ’ চালায়। দেশের অন্যতম বড় দুটি মাজার শাহজালাল রহ. ও শাহপরান রহ.-এর মাজারেও সাপ্তাহিক উরস বন্ধ করা হয়েছে। আর শাহপরান মাজারে তো খোদ হামলা-ভাঙচুর ও ফকির-মাজার ভক্তদের মারধর করা হয়েছে। এসব ঘটনায় কোনো মামলাও হয়নি, রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো আইনত ব্যবস্থাও এখন পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। যা জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার যে বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে মানুষ আশার আলো দেখছে। কিন্তু দিনদিন যে মানুষের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়ছে, তাতে সরকারের প্রতি আস্থার ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এই যে, নারীদের পোশাকের জন্য হেনস্তা করা হচ্ছে, গান গাইলে, উরস করলে মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে, কিন্তু এর বিপরীতে সরকার কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। জনগণের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে পারছে না। এ নিয়ে জনঅসন্তোষ বাড়বে, যদি বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না। ফলে নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নটা বাস্তব রূপ দেখবে না।
এই যে সবকিছুতেই শুধু আপত্তি, বাধা আর হুমকি দেওয়া সংস্কৃতি, এর একটা মীমাংসায় আসা প্রয়োজন। সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে একজন বিজ্ঞ আলেম আছেন। তিনিসহ তার সরকার ইসলামি দলগুলোকে উদারতাবাদের দিকে নিয়ে আসার ভূমিকা পালন করতে পারেন। দেশের কল্যাণের জন্য এটা দরকার।
যেকোনো সমাজে বহুমত ও পথের মানুষ থাকবেই। ভিন্নমত ও পথের প্রতি আগ্রাসী হলে সমাজ ও রাষ্ট্র এগোতে পারে না। তাই হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামি দলগুলোর উচিত কট্টরতার পথ থেকে সরে আসা। যার যার ধর্ম, সংস্কৃতি, মতাদর্শ পালন করতে দেওয়া। সমৃদ্ধি ও ঐক্যের বাংলাদেশ গড়তে হলে হস্তক্ষেপের সংস্কৃতি পরিত্যাগ করতে হবে। ‘আমরা হাত দিয়ে বাধা দিব’-ধরনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া কোনোকিছুই গ্রহণ করে না। নইলে মোল্লা-মৌলভীদের প্রতি মানুষের যে সম্মান-শ্রদ্ধা আছে, তা আর থাকবে না। তাই মানুষ ক্ষেপে যাওয়ার আগেই আধিপত্যবাদী আচরণ পরিহার করা দরকার।
মিসবাহ জামিল : সহসম্পাদক, বাংলাদেশের খবর