কর্মস্থল বসুন্ধরা এলাকায় হওয়ার সুবাদে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত আমার। বাস থেকে নেমেই ফুটওভার ব্রিজের তলায় জনতার প্রস্রাবের ঝাঁঝালো ঘ্রাণে প্রতিদিনই নাক মুখ কপাল কুঁচকে যায়। আজকের বিষয়টা অন্যরকম। প্রস্রাবের ঘ্রাণ টেরই পেলাম না। তার আগেই এক অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য আমাকে চমকে দিল। অন্তত এক মিনিট ধরে আমার নাক মুখ কপাল হাত পা পুরো শরীরে কাঁপন অনুভব করছিলাম। জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছিলাম, কিন্তু হৃৎপিণ্ড যেন অক্সিজেন খুঁজে পাচ্ছিলো না। যা দেখেছি সেটা আমার মত দুর্বল হৃদয় সম্পন্ন মানুষের জন্য সংবেদনশীলই বলতে হয়। বলে বোঝাতেও রীতিমতো মস্তিষ্কে স্মৃতির তীক্ষ্ম আঁচর টের পাচ্ছি।
শিশুটার বয়স কত হবে বলতে পারব না। আগুন রোদে অপলক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে নিরুপায় তাকিয়ে আছে। চোখ বুজতে চাইলেও সেটা সম্ভব না, চোখের পাতা নেই বললেই চলে, চামড়ার সাথে মিশে গেছে। চক্ষুগোলক ঘিরে রক্তহীন গোলাপি অংশ বেরিয়ে আছে। নিথর সে চাহনি এখনও চমকে দিচ্ছে আমায়। ফুটপাতের ধুলায় আবৃত শরীরে নড়াচড়া নেই, শুধু শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। মুখের বাকিটুকুর অবস্থাও একইরকম। মনে হচ্ছে থেতলে নাক-মুখ এক হয়ে গেছে।
পাশের মহিলাটি শিশুর মা ছিল কিনা বুঝতে পারলাম না। আসলে কোন মা তার প্রতিবন্ধী সন্তানকে এভাবে কষ্ট দিয়ে ভিক্ষে করবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সামনের ভিক্ষের থালায় টাকা-পয়সা ছিল কি না দেখার সময় পাইনি, তার আগেই শরীর গুলিয়ে গেল, সরে পড়লাম। স্বাভাবিক হতে হতে বেশ খানিকটা পথ চলে এসেছি।
ভিক্ষে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আবার সেই দৃশ্য দেখার সাহস যোগাতে পারলাম না। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিল। উপরওয়ালার কাছে মনে মনে দোয়া করতে গেলাম, কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলাম না- কী দোয়া করব? এ শিশুর যে অবস্থা দেখেছি, বাস্তবতা চিন্তা করলে সুস্থতাতো অসম্ভব। তাহলে উপরওয়ালার কাছে কী চাইবো তার জন্য? মনে যে চিন্তাটা আসছে সেটা কি ঠিক? কারো মৃত্যু কামনা কি অসভ্যতা নয়? কিন্তু এই শিশুর জন্যেতো মৃত্যুতেই মুক্তি। যতদিন বেঁচে থাকবে কেউ না কেউ তাকে জীবিকার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করবে, তার কোন উপকার তাতে হবে কি? তার খাওয়া পড়া চিকিৎসায় কারো মনোযোগ থাকলে কি এ অবস্থায় ফুটপাতে পড়ে থাকে সে?
ভাবছি আর হাঁটছি। এ কেমন এক অভিশপ্ত জীবন! কিন্তু শিশুর প্রতি আবার অভিশাপ কে দিবে?! নিষ্পাপ হয়েও কার পাপের বোঝা সে বয়ে বেড়াচ্ছে? কেনই বা তার এমন হাল- ভেবে মন শান্ত হচ্ছে না। আমিওতো তেমন কিছুই করতে পারিনি, বরং দৌড়ে চলে এসেছি। মন শক্ত করে একবার কাছেও যাইনি। নিজেকে স্বার্থপর অনুভব করলাম। ছোট মনে হল চূড়ান্তভাবে। ফিরে যাব কিনা ভাবছিলাম। এদিকে অফিসে শিফট শুরু হয়ে যাবে, লেট করা যাবে না। অফিসের দিকে হাঁটা থামালাম না। কিন্তু মাথা থেকে শিশুটার কথা নামছিল না।
অপরাধবোধ থেকে বাঁচার জন্যে উপরওয়ালার কাছে মনে মনে ক্ষমা চাইলাম, নিজের জন্য, ঐ শিশুটার জন্য। কারো মৃত্যু চাওয়া যত অসভ্যতাই হোক, শিশুটার বেলায় হয়ত– ‘ক্ষমা’র অপর নাম ‘মৃত্যু’ই।
মো. হাসিবুর রহমান : হেড অব প্রোগ্রাম, বাংলাদেশের খবর
এইআর/এমএইচএস