ফুটপাতের আলো-আঁধারে এক মায়ের জীবনসংগ্রাম
প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২৫, ২৩:১৪
-67eacd93bb55e.jpg)
বিকেলের রোদ মিলিয়ে আসে, কিন্তু রুবিনার চোখেও নামে অন্ধকার। মানিক মিয়া এভিনিউর ফুটপাথে এক টুকরো পলিথিন বিছিয়ে সাজিয়ে রাখেন রঙিন চুড়ি, ঝলমলে কানের দুল। হাতের শিরা-উপশিরা ফুলে উঠেছে বয়সের ভারে। তবুও হাত বাড়ান প্রতিটি পথচারীর দিকে- ‘দিদি, একটু দেখবেন? খুব সস্তা! দিব? চুড়ি নিবেন চুড়ি?’
রুবিনার দিন শুরু হয় খানিকটা আশা নিয়ে, শেষ হয় এক মুঠো হতাশা আর চোখের জলে। ফুটপাথে বসে থাকা এই নারীর জীবন যেন বাংলার হাজারো অবহেলিত মানুষের করুণ গল্পের বাস্তবচিত্র । প্রতিটি চুড়ির গায়ে লেগে আছে তার অদৃশ্য অশ্রুর ছোঁয়া।
সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় শাপলাকে বলেছিলেন, ‘আজ কিছু টাকা এনে দেব মা।’ কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই বুঝতে পারলেন, আজও প্রতিশ্রুতি রাখা হবে না। পলিথিনে সাজানো চুড়িগুলো যেন তাকে প্রশ্ন করে, ‘কেন আমাদের কেউ কিনে নিল না?’ কিংবা ‘একটি চুড়ির দামে কি একটি জীবন বদলানো যায়?’
যে হাতগুলো কখনো চুড়ি পরেনি, সেই হাতেই আজ শত চুড়ির বোঝা। রুবিনার হাতের তালুতে জীবনকালের ক্লান্তির দাগ। এই হাতগুলো কখনো নিজের জন্য সৌন্দর্য বেছে নেয়নি। আজ সে হাতেই বহন করে চলেছেন অন্য নারীদের সাজের সামগ্রী। ‘আমার বয়সী মেয়েরা নাতনিদের নিয়ে বাজারে যায়’, বলতে গিয়ে তার কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে রুবিনার, ‘আমার তো শুধু এই ফুটপাত। জীবনের শেষ বেলায় চলে এসছি। আর কয়টা দিন বা পৃথিবীতে থাকবো। তবুও দেখেন সুখ নামক সুখপাখিটার সন্ধান পেলাম না! জানেন আমার জীবনটা আমার ভাঙা চুড়ির মতোই। বিয়ের পর না পেলাম স্বামীর ভালোবাসা, না পেলাম সন্তানদের সুখ। ঈশ্বর বড়ই নিষ্টুরভাবে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমিও দেখি, আর কতদিন এভাবে আমার পরীক্ষা নেন তিনি!’
রুবিনার সাথে গল্প করতে গিয়ে কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে তা সত্যি বুঝতে পারিনি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখি পাশের দোকানগুলোতে জ্বলে ওঠে উজ্জ্বল আলো। রুবিনাও তখন একটি কাঠের লম্বা লাঠিতে জ্বালিয়ে দিলেন আলো।
রুবিনার সামনের পলিথিনে পড়ে থাকে কয়েকটি ভাঙা চুড়ি। বিক্রি হোক বা না-হোক, ক্রেতাকে দেখাতে গেলে কাচের চুড়ি কিছু ভেঙেই যায়। সেসবের হিসাব করে না কেউ। গভীরভাবে ভাবলে মনে হয় যেন রুবিনারই জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে ফুটপাতে বিছানো পলিথিনে ভাঙা চুড়ির টুকরায়। পাশ দিয়ে এক যুবক যাচ্ছিল। সে তাকে দেখে হেসে বলছিল, ‘বুড়ি, এগুলো এখন কে কিনবে?’ রুবিনা চুপ করে থাকেন। তার হয়ে উত্তর দেয় ফুটপাতের নিঃশব্দতা।
রাতের অন্ধকারে যখন সবাই বাড়ি ফেরে, রুবিনা তখন সেই ফুটপাতে একা বসে থাকেন। তার মনে হয়, এই শহরের প্রতিটি আলো যেন তাকে বিদ্রূপ করছে। ‘শাপলাকে কী বলব আজ?’ এই চিন্তায় তার বুকটা ধুকধুক করে। হয়তো আজও তাকে বলতে হবে, ‘কাল দিব মা...’
কিন্তু পথিকেরা তাকায় না। কেউ ঠেলে চলে যায়, কেউবা অবজ্ঞায় উড়িয়ে দেয়। রুবিনার ঠোঁট কাঁপে, চোখে জমে জল—‘আজও ভাড়া বাদ দিয়ে লাভ হলো না...’
আগামীকাল যখন আপনি মানিক মিয়া এভিনিউ দিয়ে হেঁটে যাবেন, দেখবেন গেটের একটু পাসে বটগাছের বিপরীতে পলিথিন বিছিয়ে বসে আছেন রুবিনা। একবার থেমে তার দিকে তাকিয়ে দেখুন- তার চোখে যে আশার আলোটা এখনো নিভে যায়নি, সেটা যেন এক মুঠো টাকার চেয়েও বড় কিছু। হয়তো আপনার কেনা একটি চুড়িই আজ রুবিনাকে বলতে সাহায্য করবে, ‘শাপলা মা, আজ তোর জন্য কিছু এনেছি...’
জেসি/এমএইচএস