Logo

রাজনীতি

রাজনীতির মাঠে নানা বিরোধ

এম এ বাবর

এম এ বাবর

প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:৪৯

রাজনীতির মাঠে নানা বিরোধ

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও তার আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ডামাডোলে, রাজনীতির ময়দানে নতুন করে আলোচনা, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে। কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের পক্ষে মত দিয়েছে। তবে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এ ধরনের নিরপেক্ষ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তাদের শঙ্কা, এর মাধ্যমে দেশে আর একটি ওয়ান-ইলেভেন (১/১১) সরকার গঠন হয়ে যেতে পারে।    

প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নির্বাচন পদ্ধতি। নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে, নাকি অনির্বাচিত নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে; এ নিয়ে দফায় দফায় উত্তাপ ছড়িয়েছে দেশের রাজনীতি। এমন বিতর্কের অবসান হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। তখন প্রবল বিক্ষোভের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে ক্ষমতাসীন বিএনপি। কিন্তু ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে এই নির্বাচন পদ্ধতি বাতিল করে দেয়। যদিও, এর আগে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চারটি সংসদ নির্বাচন হয়। তবে সে সময়ও এই ব্যবস্থার বেশ কিছু দুর্বলতা চিহ্নিত করেছিল রাজনৈতিক দলগুলো। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক প্রধান কে হবেন; তা নিয়ে আদালতের রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতির পদকে বাদ দেওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। 

সংবিধানের যে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করা হয়েছিল, গত ১৭ ডিসেম্বর তার কিছু অংশ বাতিল করেছেন হাইকোর্ট। এর ফলে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের বিধান বাতিল হয়েছে। ফিরল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ও গণভোট। এরপর থেকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে। বিশেষ করে রাজনীতির ময়দানে নতুন করে আলোচনা বিএনপির নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি নিয়ে।

এদিকে জুলাই ঘোষণাপত্রের অস্পষ্টতা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষার্থীদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আশঙ্কা থেকেই নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। আর এই মুহূর্তে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের কোনো প্রয়োজন দেখছে না জামায়াতে ইসলামী। আর বিএনপির দাবিকে গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধাচরণ উল্লেখ করে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমেই দেশের রাজনীতিতে সমতা ফিরবে বলে মনে করছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। এক আলোচনা সভায়, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের পর জবাব আসে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদসহ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরুণ নেতাদের পক্ষ থেকে। বিএনপির এমন দাবিকে আরেকটা ১/১১’র ইঙ্গিত বলছেন তারা।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা এ সরকারকে নিরপেক্ষই বলছি। তাহলে আরেকটি নিরপেক্ষ সরকারের প্রশ্ন আসবে কেন? ছাত্রদের অভিযোগকে ভিত্তিহীন দাবি করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ সদস্য বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের অস্পষ্টতা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রদের নতুন দল গঠনের আশঙ্কা থেকেই নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলছেন তারা।

তিনি বলেন, এটা একদমই অযৌক্তিক একটা কথা। কেননা এ বাংলাদেশে ১/১১-এর মাধ্যমে সব থেকে নির্যাতিত দল হলো বিএনপি। এখন ঘোষণাপত্রের কথা বলছে। কিন্তু এ ঘোষণাপত্রটা কীসের? এটা কি কোনো রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণাপত্র? রাজনৈতিক দল গঠনের সঙ্গে যদি সরকারের সম্পৃক্ততা থাকে তাহলে সরকার নিরপেক্ষতা হারাবেই। 

আগামীতে নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বিএনপির সঙ্গে তার দল এতদিন যে আন্দোলন করেছে, সেটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ছিল না। সেটি ছিল অন্তর্র্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে। স্বৈরাচারের পতন হয়েছে, সেই সরকার প্রতিষ্ঠা এখন সম্ভব হয়েছে। এখন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই সরকার ঠিক করবে পরবর্তী নির্বাচন কীভাবে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি আদালতে আবেদন করলেও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে তারা নেই। আদালত কী সিদ্ধান্ত দেন, তা দেখে তার দলের পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ করবে। 

সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আগে যদি পরপর তিনটি নির্বাচন এ ব্যবস্থায় করা যেত, তাহলে ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্যে দেশ চলে আসত। দেখা গেল, ক্ষমতাসীনরা এটা রক্ষা করেনি, পরে আওয়ামী লীগ এ ব্যবস্থা বাদ দিল। যেটি বর্তমান সংকটের অন্যতম কারণ। বিএনপির সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের মাধ্যমে একটি সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল। এ ব্যবস্থা নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে ফিরিয়ে এনে সরকারের কাজ সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত। তাহলে তারা শুধু নির্বাচনী কাজেই জড়িত হবে, নির্বাচনের পর চলে যাবে।

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মনে করেছেন, এই মুহূর্তে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দূর করতে বিএনপির দাবিকে আরও সুস্পষ্ট করার আহ্বান তার।  

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, তাদের এমন কোনো ভূমিকা আমার কাছে মনে হয়নি। যে আরেকটি নিরপেক্ষ সরকারের এ মুহূর্তে কোনো প্রয়োজন আছে। তারা যদি এ বিষয়টিতে খুব সিরিয়াস হয় তাহলে আমি মনে করি আরও স্পষ্টভাবে এ সরকারের নিরপেক্ষতা কোন কোন দিক থেকে প্রশ্নবোধক হচ্ছে সেটা পরিষ্কার হলেই আর বিভ্রান্তি হবে না। তবে জাতির কাছে এটা পরিষ্কার করা দরকার।

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, কোনো দলের পারপাস সার্ভ করার জন্য বা কোনো ধরনের রাজনীতিকে স্টাবলিশ করার জন্য বাংলাদেশে দুই হাজার মানুষ জীবন দেয়নি। কমিশনগুলোর যে সংস্কার প্রতিবেদন এসেছে সেগুলো ইমপ্লিমেন্টেশনের দিকে যাওয়া উচিত। যাতে করে আমরা গণপরিষদের দিকে এগোতে পারি। সেখানে এগোতে পারলে একটা নতুন সংবিধান পুনর্লিখন হবে। এর মাধ্যমে আমাদের জেন জি আদর করে যে বাংলাদেশ ২.০ বলে সেদিকে আমরা এগিয়ে যাব।

এমন প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী মনে করেন, শিক্ষার্থীদের নতুন দলের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক স্পষ্ট করা জরুরি। একই সঙ্গে, সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব কমাতে না পারলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে দেশের রাজনীতিতে। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, লোকমুখে এ প্রচার আছে, যারা সরকারে আছে তাদের সঙ্গে হয়তো নবগঠিত রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক থাকতে পারে। যদি এটা প্রমাণ হয়ে যায় তখন শেখ হাসিনার মতো সমস্যা তৈরি হবে। বিএনপি এবং সরকার যদি একে অপরকে সহযোগিতা না করে, বিএনপি এবং সরকার যদি একে অন্যের কমপ্লিমেন্টারি না হয় তাহলে কারও জন্যই ভালো হবে না। এতে করে দেশে আরও একটি ১/১১-এর মতো সরকার গঠন হওয়ার পথ সৃষ্টি হবে।

ওএফ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর