পবিত্র কোরআনের ১১৪টি সুরাকে ৩০ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। পরিভাষায় যেগুলোকে পারা বলা হয়। মাহে রমজানে বাংলাদেশের খবরের পাঠক-শ্রোতাদের দিনে এক পারা করে তিলাওয়াত উপহার দেওয়া হবে ইনশাআল্লাহ। তিলাওয়াত করেছেন রাজধানী ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত মাদরাসাতুল মারওয়াহর প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম হাফেজ মাওলানা কারী মাঈনুদ্দীন ওয়াদুদ।
শুক্রবার (২০ রমজান, ২১ মার্চ) রইল ২০তম পারার তিলাওয়াত। আজকের তিলাওয়াতে রয়েছে সুরা নামলের প্রথম ৬০ আয়াত থেকে শেষ পর্যন্ত, সুরা কাসাস ও সুরা আনকাবুতের প্রথম ৪৪ আয়াত।
সুরা নামলের সারমর্ম
মানবজাতির হেদায়েতের জন্য পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে। বিজ্ঞানের অনেক গবেষণা ও আবিষ্কারের সঙ্গে এর বর্ণনা মিলে যায়। পিঁপড়ের বিষয়টিও তেমন। বিজ্ঞানীরা পিঁপড়ের জীবনপদ্ধতি গবেষণা করে যে সারমর্মে উপনীত হয়েছেন, তা কোরআনের আয়াত থেকেই বোঝা যায়। আর এখানেই কোরআনের শ্রেষ্ঠত্ব।
আরবি ‘নামল’ শব্দের অর্থ পিঁপড়ে। এই নামেই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে এই সুরাটি নাজিল করেছেন। তাতে পিঁপড়ে সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘যখন সোলায়মান এবং তার বাহিনী পিঁপড়ের উপত্যকায় পৌঁছল, তখন এক নারী পিঁপড়ে বলল, হে পিঁপড়েরা! তোমাদের গর্তে প্রবেশ করো। এমন যেন না হয়, সোলায়মান এবং তার সৈন্যরা তোমাদের পিষে ফেলবে, তোমরা তা টেরও পাবে না। সোলায়মান (আ.) পিঁপড়ের কথায় মৃদু হাসলেন।’ (সুরা : নামল, আয়াত : ১৮)
আরবি ভাষায় বিবেকসম্পন্ন প্রাণীর জন্য পুংলিঙ্গ আর বিবেকবর্জিত ও জড় পদার্থের জন্য স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ ব্যবহারের একটি নিয়ম আছে। মহান আল্লাহপাক পিঁপড়ের সংলাপ বর্ণনা করতে গিয়ে পুংলিঙ্গ শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা প্রমাণ করে বুদ্ধি ও জীবনযাত্রার দিক থেকে পিঁপড়ে এবং মানুষ সমান বা কাছাকাছি পর্যায়ের প্রাণী।
তাদের সর্দারকে কোরআনে ‘নামলাহ’ তথা নারী পিঁপড়ে বলা হয়েছে। আয়াত থেকে এ কথাও পরিষ্কার হয় যে, সোলায়মান (আ.)-এর বাহিনী অনেক দূরে থাকতেই তারা আগমনবার্তা পেয়ে যায়। তাছাড়া কোরআনের শব্দ বিশ্লেষণ এবং আরবি ভাষারীতি বলছে, মানুষ যেমন বিবেকসম্পন্ন প্রাণী, পিঁপড়েও তেমনি বোধসম্পন্ন প্রাণী।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীতে ২২ হাজার প্রজাতির পিঁপড়ে রয়েছে। এর মধ্যে বিজ্ঞানীরা ১২ হাজার ৫০০ প্রজাতির পিঁপড়ের শ্রেণিবিন্যাস করতে পেরেছেন। পিঁপড়ে-মানব খ্যাত পতঙ্গবিজ্ঞানী ড. উইলসনের মতে, পিঁপড়েই একমাত্র সামাজিক পতঙ্গ। মানুষের মতো পিঁপড়ের সমাজ, সংসার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা রয়েছে। নিজস্ব বাজার এবং উন্নত মানের যোগাযোগ ব্যবস্থাও রয়েছে তাদের মধ্যে। তারা খাদ্য সঞ্চয় করে। পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে শীতের দিন তা রোদে শুকাতে দেয়। তাদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘটে এবং মানুষের মতোই তারা চরম প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে থাকে। পিঁপড়েরা শত্রুকে হুমকি-ধমকি দেয় এবং প্রয়োজন হলে খুন করতেও দ্বিধা করে না। পিঁপড়েদের মধ্যেও আইন-আদালত এবং পুলিশের ভয় কাজ করে।
উইলসন পুরো পৃথিবী ঘুরে ৫০০ প্রজাতির পিঁপড়ের ওপর পর্যবেক্ষণ করে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, পিঁপড়েরা মানুষের মতোই তাদের মৃতদেহ কবর দেয়। পিঁপড়ের মধ্যেও রয়েছে চোর পিঁপড়ে।
সুরা নামলের উল্লিখিত আয়াত থেকে পিঁপড়ের জীবনযাত্রা সম্পর্কে আমরা চারটি ধারণা লাভ করি, যা পতঙ্গবিজ্ঞানও স্বীকার করে অকপটে।
এক. পিঁপড়ে মানুষের মতোই কথা বলতে পারে। আধুনিক বিজ্ঞানের মতে, ফেরোমন নামে একটি রাসায়নিক পদার্থের প্রতি পিঁপড়েরা সংবেদনশীল। এর মাধ্যমে তারা একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকে। এক ধরনের পিঁপড়ে ‘নিয়ার-ফিল্ড’ পদ্ধতিতে শব্দ তৈরি করে কথা বলে। একই পদ্ধতিতে একটি পিঁপড়ে একাধিক পিঁপড়ের সঙ্গে ভাববিনিময় করে। যেমন আয়াতে বর্ণিত মহিলা পিঁপড়েটি অন্যদের সঙ্গে করেছে।
দুই. পিঁপড়ে নারীশাসিত পতঙ্গ। তাদের একজন রানী থাকে। পুরুষ পিঁপড়ে ঘরে, নারী পিঁপড়ে বাইরে আর রানী পিঁপড়ে প্রজনন কাজে এ হলো পিঁপড়ে সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য। রানী পিঁপড়ের জন্য খাবার ব্যবস্থা করবে নারী পিঁপড়ে আর সেই খাবার এবং রানীকে পাহারা দেবে পুরুষ পিঁপড়ে। পতঙ্গবিদদের ভাষায় পুুরুষরা সৈনিক আর নারীরা শ্রমিক। বিজ্ঞানীদের ধারণা, খাদ্য সংগ্রহ অথবা বাইরের কোনো কাজে নারী পিঁপড়েরা যখন ব্যস্ত ছিল, ঠিক তখনই সোলায়মান (আ.) এবং তার বাহিনী এসে পড়ে। ফলে তাদের রানী সবাইকে নিজ নিজ ঘরে প্রবেশ করার নির্দেশ দেয়। নির্দেশের ধরন থেকে বোঝা যায়- নির্দেশদানকারী রানী পিঁপড়েই ছিল।
তিন. পিঁপড়ে আলাদা করে মানুষ চিনতে পারে। পিঁপড়ের মতো মানুষের শরীর থেকেও ফেরোমন পদার্থ নিঃসরণ হয়। ফলে সোলায়মান (আ.)-এর ফেরোমন সিগনেচারের মাধ্যমেই নারী পিঁপড়েটি তাকে চিনতে পেরেছিল। ঠিক একই কারণে কুকুরও প্রত্যেক মানুষকে আলাদা করে চিনতে পারে।
চার. পিঁপড়ে বিপদ সঙ্কেত বুঝতে পারে। জার্মান পতঙ্গবিজ্ঞানী উলরিশ বলেন, পিঁপড়েরা আগাম বিপদ সঙ্কেত বুঝতে পারে এবং নিজেদের বাঁচানোর জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। তবে উলরিশের দাবি শুধু লালচে বিশেষ শ্রেণির নারী পিঁপড়েই এমনটি করতে পারে। আয়াতে আমরা দেখেছি, হাজার হাজার পিঁপড়ে থেকে শুধু একটি নারী পিঁপড়ে সোলায়মানের আগমন এবং বিপদ সঙ্কেত বুঝতে পেরেছিল।
প্রযুক্তির রাজধানীখ্যাত জাপান ও জার্মানি তাদের আধুনিক সব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়েও যখন ভূমিকম্প রোধে সফল হলো না, তখন তারা প্রকৃতির দিকে আরও গভীর মনোযোগী হলো। জার্মানির খ্যাতনামা বিজ্ঞানীরা দুই বছর ধরে অনবরত ভিডিও ক্যামেরার মাধ্যমে পিঁপড়ের গতিবিধি লক্ষ করেন। তারা দেখেন, ভূমিকম্পের ঠিক আগ মুহূর্তেই পিঁপড়ের অস্থিরতা লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে যায়। পাল্টে যায় তাদের গতিবিধিও।
ডুইসবার্গ এসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ শ্রাইবার বলেন, ‘পিঁপড়ের মধ্যে যারা আগাম বিপদ সঙ্কেত বুঝতে পারে শুধু তারাই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার আশপাশে বাসা বাঁধে। কারণ এসব অঞ্চল এদের জন্য কমফোর্টেবল। এদের বেঁচে থাকার জন্য অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও উষ্ণতা প্রয়োজন, যা শুধু ওইসব এলাকার বাসাগুলোতেই পাওয়া যায়।
আজকের মুসলমানদের দিকে তাকালে বড়ই আফসোস হয়। তারা বিজ্ঞানময় কোরআন পড়া ও বোঝায় যেমন পিছিয়ে রয়েছে, তেমনি বিজ্ঞান-গবেষণা-আবিষ্কারেও পিছিয়ে রয়েছে। অথচ এ দুটির সমন্বয়েই গড়ে উঠতে পারে কল্যাণময় আধুনিক পৃথিবী।
ডিআর/বিএইচ