হাসিনার আমলে বারবার নির্যাতিত পিন্টু-টুকুর পরিবার
রেজাউল করিম, টাঙ্গাইল
প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:১৯
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি নেতাকর্মীরা ছিলেন নির্যাতিত। দলটির নেতাকর্মীরা প্রতিনিয়ত হামলা মামলার শিকার হয়েছেন। গায়েবি মামলায় অনেকেই কুঁজো হয়ে গিয়েছিল। অনেকে আবার মামলার ভয়ে দেশ ছেড়েছিলেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে তারেক রহমান বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলায় দীর্ঘদিন নেতাকর্মীদের সাথে দেখা করতে পারেননি। কারাভোগ করতে হয়েছে খালেদা জিয়াকেও।
জিয়া পরিবারের পাশাপাশি সারাদেশের বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও রেহাই পাননি হয়রানি ও গায়েবি মামলা থেকে। টাঙ্গাইলেও বিএনপি নেতাকর্মীরা হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মামলা থেকে রেহাই পায়নি ওয়ার্ড বিএনপি নেতাকর্মীরাও। টাঙ্গাইল জেলা বিএনপি সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফরহাদ ইকবাল আওয়ামী লীগ আমলে বেশ কয়েকবার কারাভোগ করেছেন। জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা যুবদলের আহ্বায়ক আশরাফ পাহেলী এ আমলে বেশ কয়েকবার কারাভোগ করেছেন। তার পরিবারের আট সদস্যকে কারাভোগ করতে হয়েছে। জেলায় সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও হয়রানির শিকার হতে হয়েছে সালাম পিন্টু-টুকু পরিবারের সদস্যদের।
রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম পিন্টু। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় গ্রেপ্তারের পর থেকে কারাগারেই রয়েছেন তিনি। তবে গত ১ ডিসেম্বর রোববার এ মামলা থেকে আব্দুস সালাম পিন্টুসহ সকল আসামি খালাস পেয়েছেন।
২০২৩ সালের ১৩ আগস্ট সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু এবং যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর মা সালমা বেগম চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকার একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তখন টুকু বলেছিলেন, ‘মৃত মাকে শেষবার দেখার জন্য প্যারোলে মুক্তি মিললেও আমার বড় ভাই আব্দুস সালাম পিন্টুকে আসতে দেওয়া হয়নি। এই নির্যাতন-নিপীড়ন কখনই ভালো পথ দেখায় না। এলাকার একজন জনপ্রতিনিধি ছিলেন আমার ভাই। সবাই তাকে ভালো মানুষ হিসেবে চেনেন। আমার ভাই তার মায়ের মরা মুখটা দেখতে পারবে না এটা কি হতে পারে!’
সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বিএনপির বর্তমান প্রচার সম্পাদক। তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রদল ও যুবদলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিও অসংখ্যবার কারাভোগ করেছেন। এর আগে ২০০৯ সালের ১ জুলাই সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে ছাত্রদলের দায়িত্ব দেওয়া হয় । ছাত্রদলের সভাপতি টুকুর নেতৃত্বে ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সাথে নবগঠিত কমিটি সাক্ষাৎ করতে গেলে ছাত্রলীগ টুকুর ওপর আক্রমন করে। রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাবির ক্যাম্পাস। মুমূর্ষু টুকুকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। এরপর থেকে টুকুর বিরুদ্ধে হামলা মামলা লেগেই আছে।
আরেক ভাই শামছুল আলম তোফা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সংসদের নির্বাচিত জিএস ছিলেন । এরপর টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আন্দোলন সংগ্রামে সবসময় থাকতেন রাজপখে। তার নামেও রয়েছে অসংখ্য মামলা ।
নির্বাচনী এলাকায় সালাম পিন্টু-টুকুদের বাসা ও সম্পত্তিতে তাণ্ডব চালানোর অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এছাড়াও গ্রেনেড হামলা মামলায় আসামি হওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে জেলা আওয়ামী লীগ। তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ।
আব্দুস সালাম পিন্টু টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯১ ও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে বিএনপি জামায়াত সরকার জোট সরকার গঠনের পর তিনি শিক্ষা উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
২০১৯ সালে ১৬ মে আব্দুস সালাম পিন্টুর বিরুদ্ধে টাঙ্গাইলের আদালতে গরু চুরিসহ লুটপাটের মামলা দেওয়া হয়। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ভূঞাপুর উপজেলার ভদ্রশিমুল গ্রামের এক আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর, চুরি ও মারপিটের অভিযোগ আনা হয় পিন্টুসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে। এভাবে অসংখ্য মামলা দিয়ে হয়রানি, রাজনৈতিক ও পারিবারিকভাবে হেনস্থাসহ নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন পিন্টু।
আবদুস সালাম পিন্টু টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার গুলিপেচা গ্রামের ডা. মরহুম মহিউদ্দিন মিয়ার জ্যৈষ্ঠ সন্তান। ডা. মহিউদ্দিন এলাকায় মহু ডাক্তার নামে পরিচিত ছিলেন। ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি কাদেরিয়া বাহিনীর আঙ্গুর কোম্পানি, হাকিম কোম্পানি, ভোলা কোম্পানি ও আরজু কোম্পানির সকল সদস্যকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছেন। সিরাজকান্দির চরে যমুনা নদীতে পাক বাহিনীর ভারি যুদ্ধাস্ত্র বহনকারী একটি জাহাজ মুক্তিবাহিনী ডুবিয়ে দেয়। ওই সময়ে এটি ছিল আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক ঘটনা। রাতারাতি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে কাদের সিদ্দিকীকে বাঘা সিদ্দিকী উপাধি দিয়ে সংবাদ প্রচার করা হয়। এই খবরে গোটা দেশবাসী উৎফুল্ল হয়ে উঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের মতে, ভারি সমরাস্ত্র বোঝাই ওই জাহাজটি উত্তরবঙ্গ সীমান্তে পৌঁছতে পারলে মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ অনেকটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়তো।
জাহাজ ডুবিয়ে দেয়ার সাথে জড়িত মুক্তিযোদ্ধারাও এসে মহু ডাক্তারের বাড়ীতে আশ্রয় নেয়। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন টাইফয়েডে আক্রান্ত। মহু ডাক্তার তাদের সবাইকে বিনামূল্যে চিকিৎসা করেন। মহু ডাক্তারের বড় ছেলে আবদুস সালাম পিন্টু। ১৯৭১ সালে পাক-বাহিনী যেদিন প্রথম ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল মার্চ করে সেদিন নাটিয়াপাড়া ব্রিজে পিন্টুর নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। সেখানে বেশ কিছু সময় যুদ্ধ চলার পর পাক-বাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে প্রতিরোধকারীরা প্রতিরোধ তুলে নিতে বাধ্য হন।
পরে পিন্টু বাড়ী ফেরার সময় পাকুটিয়া এলাকায় দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। তাকে বহনকারী গাড়ি পুকুরে পড়ে যায়। এতে গুরুতর আহত হয়ে দীর্ঘদিন তিনি বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেন।
স্বাধীনতার পরে তিনি আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে টাঙ্গাইলে আয়কর আইনজীবী হিসাবে প্রাকটিস শুরু করেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করলে তিনি টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেই থেকে তিনি বিএনপিতেই আছেন। তিনি টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূইয়াপুর) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন একাধিকবার। বর্তমানে তিনি শেখ হাসিনার সমাবেশে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে দায়েরকৃত গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি হিসাবে কারাগারে আছেন। এই পরিবারের আরো দুই ভাই মাওলানা তাজ ও বাবু। তাদের নামে রয়েছে গ্রেনেড হামলা মিথ্যা মামলা ।
টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক আশরাফ পাহেলী বলেন, জিয়া পবিারের পর সারাদেশের নেতাকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন পিন্টু-টুকুদের পরিবার। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে নানাভাবে নিপীড়ন করা হয়েছে। বারবার তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সামাজিক, অর্থনৈকিভাবে তাদেরকে নির্যাতন করা হয়েছে। পিন্টু বর্তমানে সাজানো মিথ্যা মামলায় কারাভোগ করছেন। তার নিঃশর্ত মুক্তি চাই।
তিনি বলেন, আমার পরিবারও বিগত সরকারের আমলে বারবার নির্যাতন হয়েছেন। আমার পরিবারের আট সদস্য কারাভোগ করেছেন। আমাদের সকল মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাকর্মীদের দল মূল্যায়ন করবে এমনটাই প্রত্যাশা তার।
রেজাউল করিম/ওএফ