বর্তমানে প্রযুক্তির যুগে স্মার্টফোন যেমন আমাদের জীবনকে সহজতর করেছে, তেমনি শিশুদের মধ্যে এর অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে তৈরি হচ্ছে মানসিক ও শারীরিক নানা সমস্যা। স্মার্টফোনের আসক্তি শিশুদের শেখার আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে, মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে, পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করছে। এ অবস্থায় মায়েদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে মায়েদের কিছু কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
সন্তানদেরকে তাকওয়ার শিক্ষা দেওয়া
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআনে কারিমে ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।’ (সুরা তাহরিম, আয়াত : ৬)
রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা সকলেই দায়িত্বশীল, তোমাদের প্রত্যেককেই অধীনস্থদের ব্যপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। ইমাম একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি, তাঁকে তাঁর অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। পুরুষ তার পরিবার বর্গের অভিভাবক, তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেসা করা হবে। নারী তার স্বামী-গৃহের কর্তী, তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। খাদিম তার মনিবের ধন-সম্পদের রক্ষক, তাকেও তার মনিবের ধন-সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (সহিহ বুখারি : ৮৯৩) এজন্য সন্তানদের দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্যের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া মায়েদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।মায়েদের দায়িত্ব সন্তানদের আল্লাহভীতি ও তাকওয়ার শিক্ষা দেওয়া। শিশুদের যদি ছোট থেকেই আল্লাহর ভয়, সঠিক ও ভুলের পার্থক্য শেখানো হয়, তবে তারা সহজেই প্রযুক্তির অপব্যবহার থেকে দূরে থাকবে।
শিশুর জন্য একটি সময়সূচি তৈরি করুন
শিশুর দৈনন্দিন কাজের জন্য একটি নির্দিষ্ট রুটিন নির্ধারণ করুন। এই রুটিনে পড়াশোনা, খেলা, পরিবারে সময় কাটানো। ঘুমের সময় অন্তর্ভুক্ত করুন। শিশুর হাতে স্মার্টফোন দেওয়ার আগে নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে দিন এবং সেই সময় মেনে চলার ওপর তাকে অভ্যস্ত করে তুলুন।
বিকল্প মাধ্যম বেছে নিন
শিশুদের স্মার্টফোনের আসক্তি দূর করতে বিকল্প কার্যক্রমে মনোযোগী করতে হবে। তাদের সাথে খেলাধুলা করুন, গল্প বলুন, বা সৃজনশীল কাজের দিকে উৎসাহ দিন। শিশুদের মনের মতো খেলনা বা বই কিনে দিন, যাতে তারা প্রযুক্তির বদলে সেগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়।
নিজেরা ভালো উদাহরণ সৃষ্টি করুন
মায়েরা নিজেরা যদি স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার করেন, তবে শিশুরা তা অনুসরণ করবে। তাই নিজেদের ব্যবহারে সংযম আনতে হবে। শিশুদের সামনে ফোন ব্যবহার সীমিত করে তাদেরকে দেখিয়ে দিন যে, ফোনের বাইরের জীবন আরও অনেক সুন্দর ও রঙিন।
সন্তানদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি নিশ্চিত করা
রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিজের সন্তানকে শিষ্টাচার ও আদব-কায়দা শিক্ষা দেওয়া এক ‘সা’ পরিমাণ বস্তু দান-খাইরাত করার চেয়েও উত্তম। (এক ‘সা’ হলো- ৫.৫ পাউন্ড শস্যের সমান। ৩ কেজি ২৭০ গ্রামের কিছু বেশি) তিনি আরও বলেন, কোনো পিতা তার সন্তানকে উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে বেশি উত্তম কোনো জিনিস দিতে পারে না। (তিরমিজি : ১৯৫১-৫২) মায়েরা সন্তানদের উত্তম চরিত্র ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য সময় দেবেন। ইসলামিক শিক্ষা ও কোরআন তিলাওয়াতের প্রতি তাদের আগ্রহী করবেন।
পরিবারে আলোচনা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন
পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে সময় কাটান। শিশুদের সাথে তাদের ভাবনা, সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলুন। ঘরের পরিবেশ এমন রাখুন যাতে শিশুরা প্রযুক্তির চেয়ে পরিবারের ভালোবাসা ও সান্নিধ্য বেশি উপভোগ করে।
শিশুদের প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শিখিয়ে দিন
শিশুদের প্রযুক্তির ভালো ও মন্দ দিক সম্পর্কে সচেতন করুন। শিক্ষা বা জ্ঞান অর্জনের জন্য স্মার্টফোন কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তা শেখান। তবে গেম, সোশ্যাল মিডিয়া বা অন্যান্য ক্ষতিকর অ্যাপ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করুন।
প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় কাটানোর সুযোগ দিন
শিশুদের প্রাকৃতিক পরিবেশে নিয়ে যান, যেমন পার্ক, খেলার মাঠ বা গ্রামের খোলা পরিবেশ। প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানোর মাধ্যমে শিশুদের প্রযুক্তি নির্ভরতা অনেকটাই কমে আসবে।
ধৈর্য ধরুন, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করুন
শিশুদের অভ্যাস পরিবর্তন করতে সময় লাগবে। ধৈর্য ধরে তাদের অভ্যাস পর্যবেক্ষণ করুন, নিয়মিত উৎসাহিত করুন। স্মার্টফোনের আসক্তি থেকে শিশুদের রক্ষা করা কোনো সহজ কাজ নয়। তবে মা যদি তাদের প্রতি মনোযোগী হন, সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করেন, তাহলে শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব। শিশুরা সমাজের ভবিষ্যৎ। তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব।
বিএইচ/