পিলখানা ট্র্যাজেডির নেপথ্যে দীর্ঘ পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র

বাংলাদেশের প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩:১৫

ফাইল ছবি
পিলখানা ট্র্যাজেডির ১৬ বছর পূর্ণ হলো আজ মঙ্গলবার। ইতিহাসের নৃশংসতম এই ঘটনা দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার মাধ্যমে ঘটানো হয়েছিল। এমনকি ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিল বিদেশি শক্তিও। ২০০৫ সাল থেকেই শুরু হয় ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের প্রাথমিক কাজ। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে দুর্বল নিজের শাসন ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চেয়েছিলেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পিলখানা ট্র্যাজেডির বিষয়ে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রাথমিকভাবে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে এমনই সব তথ্য।
গত ২৪ ডিসেম্বর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমানকে প্রধান করে বিডিআর হত্যাকাণ্ড তদন্তে ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। সাত সদস্যের এ কমিশনকে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
তদন্ত কমিশনের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা গেছে, ক্ষমতা কুক্ষিগতের লোভে পড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে হাসিনার মাধ্যমে একটি বিদেশি শক্তি চেয়েছিল বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে দুর্বল করতে।
তবে এসব ঘটনায় দেশের হয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল তৎকালীন বিডিআর (বর্তমান নাম বিজিবি) সদস্যরা। এতে একটি দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছিল। ঘটনাগুলো হয়েছে ২০০১ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে। এর জেরেই পরিকল্পিতভাবে ২০০৯ সালে তৎকালীন বিডিআরের সদর দপ্তর পিলখানায় ঘটানো হয় ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে কমিশনের কেউ এ প্রসঙ্গে এখনই প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, তাদের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গঠিত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে তৈরি করা হয়নি। সেগুলোতে অনেক ঘাটতি আছে। তখনকার সরকারে থাকা অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি পিলখানা হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। প্রতিবেদনগুলোয় তাদের এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। নেপথ্যে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম অতীতের কোনো প্রতিবেদনেই আসেনি।
কমিশন আরও জানতে পেরেছে, তৎকালীন সামরিক, রাজনৈতিক-দলীয় এবং গোয়েন্দা কমান্ডে থাকা অনেকেই ছিলেন পরিকল্পনায়। সেখানে সমন্বয়কারীর ভূমিকায় ছিলেন সাবেক মন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান। ‘জঘন্য’ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যেসব সেনাকর্মকর্তা প্রতিবাদ করেছেন, তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। পাশাপাশি নেওয়া হয়েছিল আয়না ঘরেও। দীর্ঘদিন ধরে বিডিআর জওয়ানদের মধ্যে নানাভাবে ক্ষোভের সৃষ্টি করেন পরিকল্পনাকারীরা।
অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, মির্জা আজম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, কর্নেল (অব.) ফারুক খান, মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিক, শেখ ফজলে নূর তাপসসহ অনেকের ভূমিকা ছিল তখন প্রশ্নবিদ্ধ।
পিলখানা ট্র্যাজেডিতে শেখ হাসিনার সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করে তদন্ত কমিশনের এক সদস্য গত ২০ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন শেষে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘গোয়েন্দা তথ্য আগে থেকেই ছিল। তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর তৎকালীন বিডিআর-প্রধান পিলখানার ভেতর থেকে ওই সময়ের সেনাপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে বারবার ফোন করে জীবন বাঁচানোর আর্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘পিলখানার ভেতরে অভিযান চালাতে সামরিক বাহিনী ও র্যাব প্রস্তুত ছিল। সঠিক নির্দেশনা না থাকায় কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। আর এ সুযোগে হত্যাকাণ্ডের পর লাশ পোড়ানো হয়েছে। মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হয়েছে। ড্রেনে-স্যুয়ারেজ লাইনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ঘাতকদের পলায়নের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এসবের দায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এড়াতে পারেন না।’
ওইদিন তিনি আরও বলেন, ‘তদন্ত কমিশনের অগ্রগতি ইতোমধ্যে গণমাধ্যমকে জানিয়েছি। ঘটনার বিস্তারিত জানতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদসহ পলাতক অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা খুবই প্রয়োজন। আমরা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিষয়টি জোরালোভাবে খতিয়ে দেখছি।’
এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর পিলখানায় ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকীসহ মোট ৫৭ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কাছে পিলখানা গণহত্যায় শহীদ সেনা অফিসারদের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযোগ প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট উদয় তাসমীর বলেন, ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা হত্যার সঙ্গে আমরা মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার সামঞ্জস্যতা পেয়েছি। এর সঙ্গে তৎকালীন অবৈধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার দোসররা জড়িত ছিলেন।
তিনি বলেন, আমরা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করেছি এরমধ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরা রয়েছেন।
১৬ বছর পর আজকের এই দিনটিকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করেছে। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। বাণীতে তিনি বলেন, গত ১৬ বছর ধরে জাতিকে বিভিন্নভাবে বিভ্রান্ত করে রাখা হয়েছিল। এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবছর ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে পালনসংক্রান্ত পরিপত্রের ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসেবে অন্তর্ভুক্তকরণের সিদ্ধান্ত হয়।
যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি পালিত হচ্ছে আজ। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বনানী কবরস্থানে সকাল ৯টায় পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। একই সময়ে সেনাবাহিনীর আয়োজনে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করা হয়। এরপর মহাখালী রাওয়া ক্লাবে ফটো এক্সিবিশনের আয়োজন করা হয়।
শহীদ পরিবারবর্গ ও শহীদ সেনা অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে মঙ্গলবার বাদ মাগরিব মিরপুর ডিওএইচএস সেন্ট্রাল মসজিদে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। আর নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্মরণে সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা, স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা বনানী কবরস্থানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাবেন। এ ছাড়া বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে পৃথক কর্মসূচি।
বিজিবি সদর দপ্তরসহ সারাদেশের বিজিবি কার্যালয়গুলোয় বাদ ফজর কুরআন খতম অনুষ্ঠিত হয়। রেজিমেন্টাল পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। বাদ আসর মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। আজকের দিনে বিজিবির সব সদস্য কালো ব্যাজ পরিধান করছেন।
- এনএমএম/এমজে/এমএইচএস
প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন